কিছুদিনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে গেছিলাম। ওই যা হয় আর কী, বাবা মায়েদের বয়েস হলে বছর বছর মেডিকাল ও অন্যান্য কারণে ট্রিপ হয়ে যায়। সেই হাসপাতাল-বাড়ি-ট্যাক্সি-মেট্রো-ব্যাঙ্ক-সরকারি অপিস ইত্যাদির গোলকধাঁধার মধ্যে খুঁজে ও খুঁটে বেশ কিছু জিনিস খাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাদের মোটামুটি একটা লিস্ট করা থাকে খাবারের যার কিছু দোকানে, বাকি বাড়িতে যোগাড় ও রান্না করে খেলে ভাল হয়। এমন সব জিনিস যা ধরুন ব্রাসেলসে পাওয়া যায় না অথবা পেলেও মান খুবই ইয়ে টাইপের। কিছু জিনিস বাবা মায়েরাই খুঁজেপেতে আনালেন, কিছু আত্মীয় বন্ধুরা যোগাড় করে দিলেন আর কিছু আমরাই ঘুরে ঘুরে খেলাম। এর মধ্যে কয়েকটি পোষালো, কয়েকটি নয়, কয়েকটি ব্যাপক লাগল, কয়েকটি মোটামুটি।
১। ঘাসপাতা দিয়েই শুরু করি। বেটার হাফের একটা দাবী থাকে পঃবঃ গেলেই, তার খেসারির শাক চাই। পরিবারের সবাই জানে এবং শীতের আশেপাশে পৌঁছলেই খোঁজার চেষ্টা করে। এবারে ডিসেম্বর শুরুতে ছিলাম বলে বেটার হাফের মাসি এলাকার বাজারে বলেকয়ে খেসারি যোগাড় করে, রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমার এমন কিছু উথালিপাতালি নেই খেসারি নিয়ে, নিজস্ব স্বাদ নেই খুব একটা, ঠেসে কাঁচালঙ্কা দিয়ে ভাজলে খেতে ভাল লাগে অবশ্য। এক সময়ে খেসারির ডাল ব্যানড ছিল, কিন্তু এখন নয় এবং শাকটি শুনেছি খুবই উপকারী। কলকাতায় কজন খেসারি খেয়েছেন জানি না তবে আমাদের মফস্বলে শীতকালে দিব্য পাওয়া যায়।
অস্ট্রিয়া বলতেই কী মনে পড়ে? আমার তো সবার আগে মনে পড়ে যে ছোটবেলায় অস্ট্রিয়াকে প্রায়ই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতাম। তারপর ভুগোল পড়তে পড়তে জানলাম কোনটা কোন মহাদেশে, কতদূরে। অস্ট্রিয়া মানেই ভিয়েনা কনভেনশন আর সলজবার্গের পটভূমিকায় ‘সাউন্ড অফ মিউজিক’ ছবিটি। এ ছাড়া বিখ্যাত জায়গা বলতে হলস্ট্যাট আর ইন্সব্রুক। হলস্ট্যাট ছাড়া আরও অনেক ওরকম ছোট ছোট পাহাড়ে আর লেকে ঘেরা গ্রাম আছে যদিও, কিন্তু হলস্ট্যাট পর্যটকদের বেশি পছন্দ যাতায়াতের সুবিধার জন্য, সলজবার্গ থেকে দু ঘন্টা মোটে। ইন্সব্রুকে আমরা যাইনি গতবার, সেও পাহাড়ে ঘেরা আর Swarovski ক্রিস্টালের ফ্যাক্টরি/মিউজিয়াম আছে।
সলজবার্গ শহর
ব্রাসেলস থেকে সলজবার্গ যেতে গোটা দুই-তিন ট্রেন পালটাতে হয়, সময়ও বেশি লাগে, তাই আমরা ফ্লাইটে পৌঁছলাম ভিয়েনা। এয়ারপোর্টে ব্রেকফাস্ট করে নীচের টার্মিনালে গিয়ে ট্রেন ধরে পৌঁছলাম সলজবার্গ। ইউরোপের এই ট্রেন জার্নি গুলো আমার ভীষণ প্রিয়। ছোট ছোট গ্রাম, জনপদের ওপর দিয়ে হুশ হুশ করে হাই স্পীড ট্রেন চলে, চওড়া জানালা দিয়ে স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখা যায়, কোথাও পাহাড়, কোথাও ব্রীজের তলায় বয়ে যাওয়া খরস্রোতা ঝর্ণাসম নদী, আবার কোথাও ঝম ঝম করতে করতে সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে যাত্রা। এমন অফুরান সৌন্দর্য্যের ভান্ডার দেখে দেখেও মন ভরে না যেন। যাইহোক, সলজবার্গে এসে দুপুর বারোটায় আবার ক্ষিদে পেয়ে গেল। স্টেশনের বাইরে একটা ছোট্ট লেবানিজ দোকানে পিটা ব্রেড – দোনের কাবাব দিয়ে লাঞ্চ সেরে হোটেলে পৌঁছলাম। বাকি দিনটা সলজবার্গের কাসল ও কিছুটা শহর দেখে ক্লান্ত হয়ে দিনের শেষে ঢুঁ মারলাম হোটেল থেকে এক কিমি দূরে এক ফিউশন ওপেন এয়ার রেস্তোঁরায়। জুলাইয়ের গরমে রোদে ঘুরে আমি বেশ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম, তাই সবার আগে অর্ডার দেওয়া হল ঠান্ডা ক্রাফট বিয়ার।
জার্মানি আর অস্ট্রিয়া তাদের হালকা আর সুস্বাদু বিয়ারের জন্যে বিখ্যাত, গরমকালের আদর্শ। খোলা বাগানে গোধূলির আলোয় বসে ঠান্ডা বিয়ারে চুমুক দিয়ে পরের অর্ডার সোজা পোর্ক শ্নিটজেল (schnitzel), সঙ্গে রোজমেরি দিয়ে রোস্ট আলু আর ক্র্যানবেরি চাটনি। ভাজাভুজি আমার খুব প্রিয়, তাই শ্নিটজেল পেলে সুযোগ ছাড়ি না। অপর পক্ষের অর্ডার হল রোস্ট পোর্ক, সঙ্গে আলুর সেদ্ধ পুলি আর একটু সব্জি দিয়ে গ্রেভি। দুটোই প্রচন্ড ভাল ছিল, এবং ফিউশন বললেও, এগুলি অস্ট্রিয়ার নিজস্ব খাবার, ঘরের খাবার। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে, ঠান্ডা হয়ে আমরা হেঁটে হোটেলে ফিরে ঘুম দিলাম।
পোর্ক শ্নিটজেল ও রোস্ট পোর্ক
পরের দিন সকালে উঠে রেডি হয়েই সলজবার্গ স্টেশনে গিয়ে বাস ধরে রওনা দিলাম, নামব বাদ ইশল (Bad Ischl) বলে এক জায়গায়, সেখান থেকে ট্রেন ধরে সোজা হলস্ট্যাট। এই বাস-ট্রেন সফর এবং হলস্ট্যাটে ঘোরা নিয়ে আলাদা করে লিখব পরে, সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা, জীবনে না ভোলার মত। আমি আমেরিকায় থাকলেও পাহাড় ঘেরা জায়গাগুলিতে ঘোরার সুযোগ হয়নি, ছাত্রজীবনে পয়সাও ছিল না। আর ইউরোপে এসেও এখনো সুইজারল্যান্ড যাইনি। কাজেই হলস্ট্যাট আমার সেরা লেগেছে। চারিদিকে পাহাড়, মাঝে বিশাল লেক আর তার ধারে রাস্তা ও ফুটপাথ কেটে দোকানপাট বাড়িঘর, অসাধারণ সুন্দর।
গঙ্গা পদ্মা দিয়ে বহু জল বয়ে অবশেষে কোরোনার বর্ষপূর্তি হয়ে গেল দেশে দেশে। যে অতিমারীর প্রকোপ কমবে এমনটা আশা ছিল, তার জায়গায় দেশে বীভৎসাকার নিয়েছে এখন দ্বিতীয় ঢেউ। এ বছরের শুরুটা ভাল হবে ভেবেছিলাম, কিন্তু বিধি বাম। নাকি ডান? একাশি দিন টানা কলকাতায় শেষ কবে থেকেছি মনে নেই, গত এক দশকে তো নয়ই। ছুটি কাটানো আর এই আপদকালীন বসবাসের মধ্যে যে কী আকাশ পাতাল তফাত তা বোঝানো কঠিন। শোক, ত্রাস, স্বজন বিয়োগ ও কোভিডাক্রান্ত হওয়া – সব মিলিয়ে সে এক ভয়ানক ব্যাপার।
আপাতত দিন কাটছে শম্বুক গতিতে। গত এক মাস ধরে সোশাল মিডিয়াতে মৃত্যু মিছিল ও হাসপাতাল-অক্সিজেনের জন্য যে হাহাকার দেখছি, তা অবর্ণনীয়। প্রত্যেক দিন সকালে তবু দাঁতে দাঁত চেপে প্রযুক্তি ও তথ্যকে সম্বল করে বেশ কিছু মানুষ প্রাণপন চেষ্টা করে চলেছে বহু রোগীকে সাহায্য করতে। সেই কেবিসিতে ‘ফাস্টেস্ট ফিংগার ফার্স্ট’ মনে আছে? সোশাল মিডিয়াতে আবেদনগুলি এলেই এখন সেইভাবে রিসোর্স খুঁজতে হচ্ছে। দশ মিনিট দেরী হলেই বেড চলে যাচ্ছে অন্য কারুর কাছে, অক্সিজেন ফুরিয়ে যাচ্ছে, ওষুধের স্টক নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। একেকটা মুহূর্ত অসহনীয় লাগে প্রতিদিন।
জীবনটা বর্তমানে যেমন, তেমনটা অবশ্যই চাই না। জীবন হোক – পাশের বাড়ির আড়াই বছরের শিশুটির মত, যে তিন দিন পর মলত্যাগ করলে তার বাবা বলে, “বাহ, সুন্দর হয়েছে,” – অথবা ওই একই শিশুটির বাবার মত, যে অতিমারীতে রুজি রোজগার ভুলে সকাল সন্ধ্যা শুধু ছেলেকে ‘ব্যানানা’ বা ‘ওয়াটার’ খাওয়ায় (ওই পটিরই আশায়) – অথবা, ওই শিশুটিরই মায়ের মত, যে আড়াই বছরের বালককে অসীম ও অলীক আশা নিয়ে জিজ্ঞ্যেস করে, “বাবু তুই বড় হয়ে আমাদের দেখবি তো?”
চারিদিকে মারণ ভাইরাস, ব্যাধি, মৃত্যু, বেকারত্ব তাদের খুব একটা স্পর্শ করে না। ঘরের সামনের ঢাকা বারান্দাটুকুতে তারা তাদের শিশুটিকে নিয়ে ছোট্ট সংসার বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বেশি ভাবে না বলেই হয়ত তাদের মনে এই দুশ্চিন্তা আসে না যে কদিন পরে ভাইরাসের থাবা তাদের ঘরের ছাউনিও উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। শিশুটি সকাল হলেই তার বাবার কিনে দেওয়া এক হাজার টাকা দামের ট্রাইসাকেলটিতে বসে স্যানিটাইজারের বোতল নিয়ে খেলা করে। তার দাদু, যিনি শিক্ষক ছিলেন, শিশুটিকে বলেন, “দেখি, Dog বলবা, বলো dog, তারপর বলবা cat।” অবসরে খবরের কাগজটি পড়ে মেয়েকে বলেন, “কাল থিক্যা আর গঙ্গার মাছ আনুম না, পুকুরের মাছ আনুম। গঙ্গার মাছে ভাইরাস পাওয়া যাইতে পারে।” শিশুটির বাবা একদিন ফোনে কাকে বলে দেয়, “কাল থেকে কদিন আমি কাজে বেরোব না, চারিদিকে কোরোনা, বাড়িতে একটা বাচ্চা আছে তো।” না চাইতেও বা না ভাবতেও কোরোনা কখন যে তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে যায়, সেটা তারা আর আলাদা করে বুঝতে পারে না।
আমার নিবাস এখন দুই বাড়িতে ভাগাভাগি করে, যেখানে যখন যেরকম কাজের প্রয়োজন, সেইমত। এক বাড়ির দিকের প্রতিবেশী শিশুটির গল্প বললাম ওপরে। অন্যদিকের বাড়িতে যখন থাকি, রোজ বিকেলে পাঁচতলার ছাদে উঠি কয়েক টুকরো জীবন প্রত্যক্ষ করার জন্য। কোনো ফ্ল্যাটের বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় টিভিতে সিরিয়াল চলছে, সোফায় বসা বৃদ্ধাকে চা এনে দিচ্ছেন বৃদ্ধ, আবার কোনও সুদূর কোণ থেকে ভেসে আসে সন্ধ্যার আগাম শাঁখের আওয়াজ, দুটো বাড়ি পরের ফ্ল্যাটের ছাদে দুটি শিশু রোজ দাপাদাপি করে খেলা করে, তাদের মায়েরা অলস আড্ডা মারে কিছুক্ষণ কাজের অবসরে। আমার বাবা-মায়ের ফ্ল্যাটটির পেছনে একটি জরাজীর্ণ তিনতলা বাড়ি আছে, তার একতলা ও তিনতলায় মানুষ বসবাস করে, দোতলাটি দেখলে মায়াই হয় – জানালার কাঠের ফ্রেম রোদে-জলে খুলে আলগা হয়ে ঝুলছে, প্লাস্টার করা নেই বাইরের দেওয়ালে, অযত্নের আগাছা শেকড়ের জন্ম দিয়েছে ইঁটের ফাঁকফোকর থেকে। শুধু তিনতলার রান্নাঘরের জানালাটি রোজ বিকেলে খোলা থাকে, ভেতরে মাইক্রোওয়েভ আভেন থেকে চিমনি সবই আছে, মনে হয় পরিবারটি গুছিয়ে সংসার করার চেষ্টা করছে। সেখানে রোজ ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে এক ভদ্রমহিলা চা বসিয়ে উদাস চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। সোজা সামনে তাকালে ওঁদের বাগান পাঁচিল ও আমাদের পরিসরটি পেরিয়ে আমার সঙ্গেই চোখাচোখি হয় ওঁর। আমি ছাদের এমাথা থেকে ওমাথা হাঁটার পথে ওঁদের দিকটায় পৌঁছলে দু সেকেন্ড থামি, উনি তাকান, হয়ত বোঝার চেষ্টা করেন যে আমি কে, আগে তো দেখেননি এই বাড়িতে। তারপর আবার আমি উল্টোদিকে হাঁটি, উনিও চায়ের কাপগুলি নিয়ে ভেতরে চলে যান। পাশের ফ্ল্যাটটির চারতলার ছাদে ওঠেন এক দম্পতি ও তাঁদের একটি শিশু। ভদ্রমহিলা নাকি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী আর ভদ্রলোক বোধহয় শিক্ষক। টুকটাক সাংসারিক আলোচনা সেরে নেন বিকেলের গুমোট বাতাসে। সব কথা হয়ত ঘরের ভেতর বলা যায় না, তাই ছাদে ওঠার সুযোগ হারাতে চান না। ওঁরা নিশ্চয়ই আমার মাকে চিনতেন, কারণ মা আগে প্রায় রোজই ছাদে উঠতেন। তাই হয়ত আমাকে দেখে অবাক হন, উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রাণীটিকে ঠিক ঠাহর করতে পারেন না। ওঁদেরই ফ্ল্যাটের তিনতলায় বাস করেন এক নব্বই ছুঁইছুঁই স্বাবলম্বী মাসিমা। একা থাকেন, দুবেলা হোম ডেলিভারিতে খাবার আসে (প্রাক ও উত্তর-কোরোনা দুই কালেই), কাজের মাসি একজন আসে সকালে আর ওঁর প্রৌঢ় ছেলে আসেন রাত্রে শুতে। বেশ কয়েক বছর ধরেই মাসিমা একা থাকেন এই ফ্ল্যাটটিতে, একবার ফোনে কাউকে বলতে শুনেছিলাম যে ছেলে বা মেয়ের সংসারে থাকা ওঁর পোষায় না তাই একা থাকেন নির্ঝঞ্ঝাটে। মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন বলে ওঁর ছেলে রাত্রে পাহারা দিতে আসেন আজকাল। পরিপাটি করে গোছানো খাট বিছানা আমাদের পশ্চিমের জানালা খুললেই দেখা যায়। লিভিং রুমে একটা ডিভানে আলতো কাত হয়ে শুয়ে উনি টিভি দেখেন, কাগজ পড়েন, ফোনালাপ করেন, রেডিও শোনেন। আপাত দেখলে মনে হবে সেই মুন্নাভাই এমবিবিএসের মত, “খাওয়া নু, পিওয়া নু এ মজ্জানি লাইফ।” তবে অন্তরে অশান্তির অববাহিকা কি আর ফল্গুধারার মতে হলেও বয়ে যায় না?
এতগুলি টুকরো সাজিয়ে সাজিয়ে কোরোনা-জীবনের যেটুকু কাঁথা বুনতে শুরু করি, এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি গিয়ে পরের বার ফেরার সময়ে মনে হয় এই সবকটি টুকরোই আবার পাব তো? নাকি কোরোনার কাঁথা থেকে এক দুটি তারার মত খসে পড়বে আমার মায়ের মত। সেই জায়গাটুকু ভরাট করার সূতাটি আর নকশাটিও তারা সঙ্গে নিয়েই যায়, অগত্যা কাঁথাটি জীবনের মতই অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
বিঃ দ্রঃ উপরোক্ত গল্পের শিশুটির ডাকনাম গদাই। শুনেই যারা নাক সিঁটকাবেন/জাজ করবেন, তাদের বলি, ওর একটা খটোমটো ভাল নামও আছে বাবা সন্দীপনের সঙ্গে মিলিয়ে, মনে পড়লে জানাব।
একটি বিশাল দর্শকভর্তি স্টেডিয়াম। চারিদিকে মানুষের উত্তেজিত কোলাহল আর তার মাঝে কয়েকটি ষাঁড়ের ক্রুদ্ধ গর্জন। সময়টা রোমান সাম্রাজ্যেরই হোক বা আজ, স্পেনে ষাঁড়ের লড়াইয়ের রীতি খুব একটা বদলায়নি। এখনও টিকিট কেটে প্রচুর মানুষ এই ‘খেলা’ দেখতে যান মাদ্রিদে মার্চ থেকে অক্টোবরের প্রত্যেক রবিবারে। কখনও ষাঁড়টি বেঁচে যায় মাতাডোরের খপ্পর থেকে, আবার কখনও তার মৃত্যু হয়। খেলার নিয়মের ডিটেলে না গেলে মোটামুটি সারাংশ এটাই। তা, মৃত্যুর পর এই ষাঁড়গুলির কী গতি হত আগেকার দিনে? স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন রেস্তোঁরা তাদের মাংস কিনে নিত। শোনা যায় এই ব্যাপারটা স্পেনের কর্ডোবাতে শুরু হয় এবং তারপর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। আজকাল আর লড়াইয়ের পরে এটা হয় না বোধহয়। তবে ইতিহাসকে অনুসরণ করে যে ঐতিহ্যকে স্পেন ধরে রেখেছে তা হল একটি খাবার – রাবো দে তোরো। ষাঁড়ের (অথবা এখন মোষেরও) লেজের মাংস, আলু এবং রেড ওয়াইন দিয়ে তৈরি এই হালকা ঝোল অসামান্য খেতে।
রাবো দে তোরো, স্যুপ, বীনস ও হ্যাম, নীচে ক্রেমা কন নাটা ও সরবেট
আমরা মাদ্রিদ পৌঁছেছিলাম গত ডিসেম্বরের এক দুপুরে। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছিল, ব্রাসেলস এয়ারপোর্টে বসে খাওয়া ব্রেকফাস্ট পেটের কোন কোণায় তলিয়ে গেছে কে জানে। হোটেলে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে ছুঁচোর কেত্তনে অতিষ্ঠ হয়ে ঠিক করলাম দূরে যাব না লাঞ্চ করতে, হাতের পাঁচ মঙ্গলবার যা রেস্তোঁরা আছে তাতেই ঢুকে পড়ি। হোটেলের ঠিক পাশেই দেখলাম একটি রেস্তোঁরার বাইরে বোর্ড টাঙানো আছে – তেরো ইউরো প্রতিজনে তিন কোর্স সেট মেনু। মুস্কিল হল ওঁরা ইংরাজি একেবারেই বলেন না। আমরা এদিকে অনেক কষ্টে কিঞ্চিৎ ফরাসী রপ্ত করেছি, কিন্তু স্প্যানিশে দৌড় তো ওই ‘ওলা’, ‘বুয়ানোস দিয়াস’ আর ‘গ্রাসিয়াস’ পর্যন্ত। গুগল ভাইপোর দৌলতে মেনু অনুবাদ করে দুজনে আলাদা আলাদা খাবার মিলিয়ে তিন কোর্স দিলাম। এর মধ্যে বেশ ‘হসমুখ লাল’ টাইপের একজন ওয়েটার এসে দুটি কোকা কোলা দিয়ে গেলেন। অর্ডার নেওয়ার সময়ে উনিই মিষ্টি করে শেখালেন কী করে ‘গ্রাসিয়াস’-এর সঠিক উচ্চারণ করতে হয়। খাবারে স্টার্টারে এল আমার জন্যে চালের সিমাই আর কাবলি ছোলা দিয়ে নিরমিষ স্যুপ, আর উল্টোদিকে বেকড এডামামে বীনসের ওপর ডিমের পোচ আর পাতলা ইবেরিকো হ্যাম। মেইন কোর্সে দুজনের জন্যেই রাবো দে তোরো – সেই প্রথমবার খেলাম আর দুর্দান্ত লাগল। বেশ রবিবারের মাংসের ঝোলের মত হালকা অথচ ফ্লেভারে কোনও খামতি নেই। শেষ পাতে ছিল আমার জন্যে ক্রেমা কন নাটা – গলানো চকলেট দিয়ে ভ্যানিলা ক্রীম আর উল্টোদিকে এল এক স্কুপ লেবুর সরবেটের সঙ্গে কমলার কোয়া। এতেই আমরা নড়তে পারছিলাম না, কিন্তু পেরুর বাসিন্দা হসমুখ ভাই ছাড়তে চাইলেন না। দুটি শট গ্লাসে ঢেলে দিলেন একরকম লোকাল পানীয়, যা নাকি হজমে সাহায্য করে। নির্দ্বিধায় খেলাম সেই ঝাঁজালো মিষ্টি শট, কারণ হজমের সত্যিই দরকার ছিল আমাদের। বলাই বাহুল্য যে এত খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে হয়েছিল হোটেলে ফিরে গিয়ে।
শুরু করি একটু গরম কফি দিয়ে। সে কী, কোনও গৌরচন্দ্রিকা নেই, কোথায় বেড়াতে গেছি, সেখানে খাওয়া ছাড়াও আর কী অভিজ্ঞতা হয়েছে – কিছু বিস্তার না করেই সোজা কফিতে? কী আর বলি, দু কাপ কফি যে কত মায়াময় হতে পারে, তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই আগে।
কল্পনা করুন একটি ক্যানালের ধারে মাঝারি ক্যাফে, ভেতরে দু-পাঁচটা টেবিল দিয়ে বসার জায়গা, জানালায় গ্রীষ্মের ফুল সাজানো আর দেওয়ালে শহরের কিছু পুরনো মানচিত্র। বাইরের টেবিলগুলি সোজা জলের ধারে, ছাতার নীচে কটা চেয়ার টেবিল পাতা, বসলেই একটু ঠান্ডা জোলো হাওয়া বয় আর সরু খালের সবুজ জলের ওপর নৌকা বেয়ে চলা দেখা যায়। সারাদিনের ক্লান্তি সারাতে দু দন্ড বসাই যথেষ্ট, চোখের ও মনের আরাম হয়। আমরা গিয়েছিলাম কোরোনা-কালে, অতএব আগে দেখা কটা টেবিল খালি, ভেতরে লোক কম কিনা এবং তারপর সাহস করে ঢুকে পড়া। স্যানিটাইজারের বাধা পেরিয়ে টেবিলে বসে অর্ডার দিয়েছিলাম দুকাপ ক্যাপুচিনো আর একটা গাবদা স্লাইস spiced ginger cake। এসব ঢঙের কেক আমাদের কম বয়সে দেশে ছিল না, মানে আদা আর মশলা দিয়ে আবার কেক হয় কীভাবে! আমেরিকাতে যেমন কুমড়োর কেকের রমরমা, এই পশ্চিম ইউরোপে spiced কেক ও পাঁউরুটি অপর্যাপ্ত। আমার দিব্যি লাগে আদা, জয়িত্রী আর দারচিনির গন্ধওয়ালা একটু ভারী কেক, বিশেষত এই শরত আর শীতকালে।
ডেলফ শহরটি দক্ষিণ হল্যান্ডে, ব্রাসেলস থেকে ট্রেনে ঘণ্টা দুয়েক। শহরটির পত্তন হয় আনুমানিক ১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দে।
বহুদিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি, স্বাভাবিকভাবেই অতিমারীর প্রকোপে। বেলজিয়ামের ভেতরে ট্রেন চলছে আগের মতই, তবে নিয়মের কড়াকড়ি ভালই। গোটা যাত্রাপথে মাস্ক পরে থাকতে হবে। পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশেরও অনেকগুণ বেশি ঘা অবধারিত। গত শনি-রবি এখানে গ্রীষ্মের শেষ রৌদ্রোজ্জ্বল দুটি দিন ছিল। আগামীকাল থেকে শরতকাল শুরু হচ্ছে, তার সঙ্গী হবে মেঘ আর বৃষ্টি, স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। তাই জয় মা বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম সমুদ্র দেখতে অস্টেন্ড শহরে। চব্বিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ঝলমলে রোদ, ঠান্ডা হাওয়া, চিংড়ি মাছ ভাজা, আর নাতিশীতোষ্ণ সমুদ্রের জল মিলিয়ে দিনটা দিব্যি কাটল। শহরের রাস্তায় মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক হলেও সমুদ্রতটে না পরলেও চলে। এমনিতে খুব বেশি লোক সমাগম হয়নি, তা ছাড়া বীচটি যথেষ্ট বড়।
চিংড়ি ভাজা
সমুদ্রে অল্প স্নান ও জলে দাপাদাপি করে বেশ ক্ষিদে পেয়ে গেছিল। দুপুর দেড়টা বাজে। প্রথমবার যখন অস্টেন্ড এসেছিলাম, স্টেশন থেকে বীচে যাবার রাস্তায় পরপর সারি দেওয়া স্টল থেকে চিংড়ি ভাজা খেয়েছিলাম। চিংড়ি হল আমার ইয়ে, যাকে আজকাল বলে BAE, কাঁচা বাদে যে কোনোভাবে যে কোনও সময়ে খাইতে পারি। সেই স্টল খুঁজে গেলাম, তবে সেখানে পাওয়া গেল হুমদো সাইজের স্ক্যাম্পি ভাজা। স্বাদে অতটা ভাল না হলেও জাস্ট চলে যায়। এক প্লেট খাওয়ার পরও যখন পেট চুঁইচুঁই, তখন আবার খাদ্যের সন্ধানে বেরোলাম। বেশ কয়েকটি রেস্তোঁরা বলল রিজার্ভেশন ছাড়া লোক ঢুকতে দিচ্ছে না, কয়েকটি বলল শনিবার দুপুরে কোনও টেবিল খালি নেই। হতাশ হয়ে ভাবছি কোনও বেকারিতে ঢুকে শুকনো স্যান্ডউইচ চিবোতে হবে, তখন চোখে পড়ল সামনের চাতালে একটি ফুড ট্রাকের গায়ে লেখা Poulet/Ribs.
দৌড়ে গিয়ে দেখি তারা ঝাঁপ ফেলার আগে মোছামুছি করছে। বড়দা ও তাঁর ছেলে ইংরিজি বলেন না যা বুঝলাম, বৌদি বরঞ্চ বলেন। আমাদের করুণ মুখ দেখে বললেন একটু রোস্ট চিকেন আছে আর একটু পোর্ক রিবস।
ইয়ান ও ক্যাট্রিয়েনের ফুড ট্রাক ছবি – গুগল
দ্বিতীয়টি শুনে আমাদের পক্ষে কোনও বিলম্ব করা সম্ভব হয়না কখনই। ওজন করে প্যাক করে ফেলছিলেন বৌদি, বললাম, একটু কেটে দেওয়া সম্ভব কী? শুয়ারের পাঁজর যতই ভালবাসি, রাস্তার বেঞ্চে বসে যখন খেতে হবে তখন জনসমক্ষে গোটা ধরে খাব কী করে? উনি মিষ্টি করেই বললেন যে দোকান বন্ধের সময় পেরিয়ে গেছে পনেরো মিনিট, এরপর পুলিশ এসে যাবে। আমরা গাঁইগুঁই করে ভাবছিলাম তাহলে চিকেন নিয়ে নি, ম্যানেজ করতে সুবিধে হবে, তখন বড়দা সমরে নামলেন। গোটা পাঁজর কেটে পিস করে, গরম করে প্যাক করে দিলেন, সঙ্গে আরো আধ কিলো জুড়ে দিলেন বিনামূল্যে।
যে দেশই হোক, যে ভাষাই হোক, ক্ষুধার ভাষা ও তার ইশারা বাচন একই। বিপাকে সাহায্য যাঁরা করেন তাদের কথা মনে গেঁথে যায় কীভাবে যেন। একটু হেসে মিষ্টি করে আবেদন করেছিলাম বলে এমন খাবার দিলেন যে তাতে আমাদের ডিনারও হয়ে গেছিল বাড়ি ফিরে।
ওহ হ্যাঁ, পাশের চাতালে গিয়ে বেঞ্চে বসে দিব্যি খেলাম রিবস। তার সামনের রেস্তোঁরার উঠোনের টেবিলে বসে একজন ভদ্রলোক কোকা-কোলা খেতে খেতে ঈর্ষার দৃষ্টিও দিলেন আমাদের খাবারের দিকে।
করোনার সংক্রমণ বাড়ছে, সঙ্গে অসহিষ্ণুতাও। শরীরে ভাইরাসের থেকেও বেশী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে মনের অসুখ। করোনার রঙ কীরকম জানিনা, কিন্তু এখন চারিদিকে তাকালেই টের পাই কেমন একটা ছায়া ছায়া ধোঁয়া ধোঁয়া আবহাওয়া, যেন গোটা পৃথিবীতে কেউ একটা কয়লার উনুন জ্বালিয়ে রেখে দিয়েছে এক কোণে। তার ধোঁয়াতে দম আটকে আসে আর তার কালিমা বেশ কিছু জনের অন্তর অব্দি সূক্ষ্ণ ছুরিকাঘাত করছে আস্তে আস্তে। পাঁচ মাসে ভাইরাস কতটা বদলাল বা মিউটেট করতে পারল জানিনা, তবে মানুষ কিন্তু আস্তে আস্তে মিউটেট করছে, শরীরে নয় অবশ্য, মনে।
কয়েক মাসে বেশ কিছু জনের কয়েকটি আচরণ লক্ষ্য করেছি, এখানে তালিকাভুক্ত করলাম, পড়ে দেখতে পারেনঃ
১। কিছু মানুষের যে কোনও কথা শুনলে কী আপনার মনে হচ্ছে, “ওই এল জ্ঞানদাচরণ আবার জ্ঞান দিতে” ?
২। কোনও বন্ধু/পরিচিত বার বার ফোন/পিং করে কুশল জিজ্ঞ্যেস করলে কী আপনি বিরক্ত হচ্ছেন? মনে হচ্ছে যে এই ব্যক্তি বড্ড গায়ে পড়া? সে কিন্তু এই দুর্বিষহ সময়ে ভাবছে একটু খোঁজ নিয়ে দেখি সব বন্ধুরা ভাল আছে কিনা।
৩। কেউ আপনার মতবিরুদ্ধ কোনও কথা বললে কী আপনি তাকে এড়িয়ে চলছেন? কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষ তো আপনার সঙ্গে একমত নাই হতে পারেন।
৪। আপনি কি কোনও মানুষকে তার লাইফস্টাইল দিয়ে বিচার করছেন? যেমন কেউ খেতে ও খাওয়াতে ভালবাসলে, আপনার কী তাকে হ্যাংলা, বেহায়া মনে হচ্ছে? কেউ ধূমপান/মদ্যপান করলে কী আপনি তাকে খারাপ মানুষ মনে করছেন, বিশেষত তিনি যদি মহিলা হন?
৫। আপনি কি কাউকে কোনও কথা বলে পরমুহূর্তে তা ভুলে যাচ্ছেন বা অস্বীকার করছেন? দেওয়ালেরও কিন্তু কান থাকে।
৬। পরিচিত বৃত্তে কেউ অল্প জনপ্রিয় হলে কী আপনার কিঞ্চিত ঈর্ষা হচ্ছে? সোশ্যাল মিডিয়াতে শুধু অতিরিক্ত নয়, একটু উচ্চমানের উপস্থিতি কিন্তু আপনাকেও জনপ্রিয় করে তুলতে পারে।
৭। আপনি কি করোনা পরিস্থিতি নিয়ে অতিরিক্ত অবসেসড? একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছেন যে পৃথিবী আর কোনোদিনও স্বাভাবিক হবে না?
উপরোক্ত তালিকার একাধিক লক্ষণ যদি আপনার মধ্যে বিদ্যমান (“হয়,” এটা নিয়ে এখন বিজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক চলছে) – তাহলে কিন্তু কিছু মনোরোগের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে এবং সত্ত্বর আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
লকডাউন এখনও অব্যাহত, আপাতত দুমাসের ওপর হয়ে গেল। আশেপাশের সবকটা গাছ ঝাঁকড়া উজ্জ্বল সবুজ হয়ে গেছে। প্রায় রোজই রোদ উঠছে, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া, চেরী গাছের ফুলগুলো ঝরে গেছে, তার জায়গায় অসম্ভব রঙীন টিউলিপে ছেয়ে গেছে পার্কগুলো। অথচ এখন বারান্দায় বেরোতেও ভয় লাগছে মাঝে মাঝে, ভাবছি ভাইরাস কি হাওয়ায় উড়ছে? আমাদের দেখেই কি তার ইচ্ছে হবে ঘাড়ে চাপতে? কয়েকদিন ধরে হাঁটতে যাচ্ছি দুজনে, মুখে মাস্ক পরে, চোরের মত জুলজুল করে এদিক ওদিক তাকিয়ে, পার্কের লম্বা জগিং ট্রেলে দৌড়বীরদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে।
দিন কেটে যাচ্ছে নিয়মমাফিক। করোনার ভয়কে সঙ্গী করে ঘর করার অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রত্যেকদিন সকালে উঠে করোনাতে মৃত্যু এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের দূরবস্থার খবর শুনে বড্ড অসহায় লাগে। কারোর কী কিছু করার নেই অবস্থা শুধরোনোর জন্যে? সরকারের কথা আর না বলাই ভাল। প্রধানমন্ত্রীকে এমনিতেও রোমের সম্রাট নিরোর সমতুল্য মনে হচ্ছে আজকাল।
বেলজিয়ামের অবস্থাও তথৈবচ। মাসদুয়েক এত দোকান-ব্যবসা বন্ধ থাকার ফলে পরিস্থিতি বেশ শোচনীয়। সরকারী ভাতা আছে বটে তবে তার নিয়মকানুনও কঠিন মনে হয়। কাল সুপারস্টোরে দেখা হল বাড়ির কাছের এক ক্যাফের বয়স্কা কর্মীর সঙ্গে। এঁরা সবাই অস্থায়ী কর্মী, তাই নিয়মিত মাইনের কোনো ব্যাপার নেই। দুঃখ করে বললেন যে লকডাউনের আগে পর্যন্ত কাজ করেছেন, কিন্তু এরপর কী হবে জানা নেই। ক্যাফে আদৌ চলবে কিনা কে জানে, ফলে ওঁকে বেরিয়ে নতুন করে কাজ করতে হবে। ভদ্রমহিলা পোল্যান্ডের, অতএব এখানে তিনি পরিযায়ী শ্রমিক। প্রৌঢ়ত্বে এসে নতুন করে কোনো কাজ শিখে বা পড়াশোনা করা ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়। পরিবেশিকার কাজেই তিনি অভ্যস্ত, কিন্তু কোনোদিন এরকম লকডাউন পরিস্থিতি আসবে, তা কল্পনাও করতে পারেননি।
এভাবেই দিনগত পাপক্ষয় হয়ে চলেছে। তবু তারমধ্যেও কিছু মানুষ হাসছে, অপরকে হাসাচ্ছে, শিশুরা খেলছে। আমাদের ছোট্ট পাড়াতে এখনো সন্ধ্যা আটটায় রোজ হাততালি দেন অল্প কিছু মানুষ। যেসব ডাক্তার-নার্স-সাফাইকর্মী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্যে; যাঁরা খাবার ডেলিভারী দিচ্ছেন রোজ, তাঁদের জন্যে; যাঁরা সুপারস্টোর/খাবারের দোকানগুলি চালাচ্ছেন, তাঁদের জন্যে, বাস-ট্রাম-মেট্রোর চালকদের জন্যে এবং সর্বোপরি তাঁদের জন্যে – যাঁরা হার মানতে রাজি নন। বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে যাঁরা খাবার পৌঁছে দেন সাইকেল/স্কুটারে করে, হাততালিতে তাঁদের চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে থাকে আমাদের পাড়া দিয়ে পেরোনোর সময়ে। কেউ আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন, কেউ সাইকেলের বেল বাজান তালে তালে, কেউবা হেলমেটের মধ্যে দিয়ে মাথাটুকু নাড়েন শুধু। বেশ কিছুদিন আগে হাততালি চলাকালীন ফাঁকা রাস্তায় একটি গাড়ি দাঁড় করিয়ে একজন প্রৌঢ়া নেমে এলেন। গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্র সবাইকে দেখিয়ে বললেন যে তিনি স্বাস্থ্যকর্মী এবং আমাদের হাততালিতে আপ্লুত। বলতে গিয়ে হয়ত ওঁর চোখ চিকচিক করছিল, যেমন আমার করছিল ওঁকে দেখে। মাঝেমধ্যেই দেখি পুলিশের গাড়ি যায় আটটা নাগাদ, সুরে সুরে হর্ন বাজিয়ে যেন হাততালির সঙ্গত করতে করতে। আর আছেন কিছু বাসচালক, যাঁরা প্রায়ই বাসের জানলাটুকু দিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে এদিক ওদিক তাকান আর চোখাচোখি হলে মিষ্টি হাসেন।
দিনের শেষে এইটুকুই তো প্রাপ্তি। যাঁরা সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন, মানুষকে খাবার-ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছেন, তাঁদের কুর্ণিশ। আমি অতি সাধারণ, রান্নাবাটি খেলা আর দুশ্চিন্তার ওপারে এই কয়েকটি অমূল্য হাসি-ধন্যবাদ কুড়োচ্ছি ভবিষ্যতের জন্যে। মানুষের জীবন পদ্মপাতায় জল, “জীন্দগী বড়ী হোনি চাহিয়ে বাবুমশাই, লম্বী নহী।”
আজ একমাস হতে চলল লকডাউনের। বাড়ির সামনের ফুটপাথ দিয়ে টুকটুক করে একেকজন দৌড়তে যাচ্ছে। কখনও সকালে, কখনও বিকালে। বসন্তের সকাল দশটার মিঠে রোদে যে বাচ্চাটি হাতে স্কেটবোর্ড নিয়ে পার্কে যাচ্ছে মা/বাবার সঙ্গে, সন্ধ্যা আটটায় পড়ন্ত রোদে হয়ত সে ফিরছে চারিদিকের বারান্দা থেকে সমবেত হাততালির মধ্যে দিয়ে। মানুষের মনে সন্দেহ, ভয়, আশঙ্কা – অসুখের, মৃত্যুর, প্রিয়জনকে হারানোর, পৃথিবীটা হঠাৎ করে ভারশুন্য হয়ে যাওয়ার। আমার মত ক্ষুদ্র মানুষেরা কীই বা করতে পারে বিদেশ থেকে, কিঞ্চিৎ অর্থসাহায্য আর এই দু চার কলম প্রলাপের প্রলেপ মাখানো বাদে। গম্ভীর তথ্য, গরম গরম ফেসবুক পোস্ট, হোয়াটসঅ্যাপে লেখা বিভিন্ন টোটকা যা কোরোনা থেকে মুক্তি দেবে – এসব আমি লিখতে পারিনা। ছোট্ট পাড়াটায় যেটুকু দেখতে পাই – কেউ ঘরের পর্দা সরিয়ে গায়ে রোদ মেখে কম্পিউটারে কাজ করছেন, কেউ অলস দুপুরে কাজ শেষে বারান্দায় বসে রোদ পোহাচ্ছেন, কারুর বাগান নতুন ফুলগাছে উপচে পড়ছে, কেউ মাসখানেকের জামাকাপড় একসঙ্গে কেচে স্ট্যান্ডে শুকোতে দিয়েছেন, কিছু শিশু বাগানে হুটোপাটি করছে পড়াশোনার পরে, কেউ বা কয়েক গেলাস ওয়াইন নিয়ে আরামকেদারায় সারা বিকেল কাটিয়ে দিচ্ছেন।
এ কদিন কাজ করতে করতে খেয়াল করিনি, রোদ উঠেছে বলে মন খারাপের মধ্যেও একটু ভাল লাগছিল। সেদিন টাইপ করতে করতে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি সামনের রাস্তায় পাঁচতলা উঁচু গাছগুলোতে পাতা এসে গেছে। নরম রোদে তারা উজ্জ্বল সবুজ হয়ে আছে। ঋতু পরিবর্তনের সময়ানুবর্তীতায় কোনো বদল হয়নি। এদিকে গৃহবন্দী অবস্থায় মাঝে মাঝে দিন/বার গুলিয়ে যাচ্ছে মানুষের। চেরী গাছে খয়েরি পাতার পাশাপাশি সাদা/গোলাপী ফুলের গুচ্ছ দেখা দিয়েছে এর মধ্যে। অন্যান্য বছর পর্যটকরা ঝাঁপিয়ে পড়েন ব্রাসেলসের বিভিন্ন রাস্তায়, হ্যাসেল্টের জাপানিজ গার্ডেনে – মুঠোফোন হাতে, ক্যামেরা কাঁধে, জল-কেক-বিয়ার ব্যাগে ভরে পিকনিকের আশায়। এবারে বাজার করতে গিয়ে কোনোমতে চেরী ব্লসমের ছবি তোলা হয়েছে, সংক্রমণের ভয়ে, আশঙ্কায়। অত্যুৎসাহী জনতা অবশ্য এখানেও চায়ের দোকানের মত ভীড় জমাচ্ছে পার্কে। পুলিশ তাড়া দিলে তাদেরও মনোভাব যেন, ‘পার্কে আসব না আমরা, আসব না আমরা পার্কে?’ সন্ধ্যা নামলে পূর্ণিমার চাঁদ যেন ব্যঙ্গ করে কিছুটা উপরি জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে, এই বিবমিষাময় সময়ের সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসাবে।
লকডাউনের আগে ভাগ্যিস দুটো রঙীন প্যানজি ফুলের গাছ কিনেছিলাম। এইটুকু বিলাসিতা করতে পেরেছি বলে এই ধূসর দিনগুলোতেও জানলা আলো করে রয়েছে এক গুচ্ছ ফুল। বারান্দার ছোট্ট বাগানে কল বের করা ছোলা পুঁতেছিলাম, তাতে একটা পুঁচকে গাছ বেরোচ্ছে। কী জানি, সে আরো বেড়ে উঠতে পারবে কিনা। একেবারে ছোলা পেড়ে খাব, সে আশা রাখিনা। শুধু বারান্দাটা আরেকটু সবুজ হয়ে উঠবে, গরমকালের ভোরের মৃদু ফুরফুরে হাওয়ায় কচি গাছগুলো মাথা নেড়ে নেড়ে নাচবে, এটুকু আশা করতে ক্ষতি কী?