না চাহিলে যারে…
ঠিক দুপুরবেলা লেপের মায়া কাটিয়ে বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছিল ঈশানী। আজকাল কলকাতা শহরে শীতটা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, নইলে ছোটবেলায় কাঁপুনির চোটে ওর মনে হত স্কুলে আরো বড় উইন্টার ভেকেশন দেয় না কেন। শীতের ওম-ওম দুপুর, ছাদে বসে শেষ রোদে গরম চায়ের কাপ হাতে ধরে আরো সেঁক দেওয়া, সন্ধ্যাবেলায় ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ করে গাঁক গাঁক করে টিভি দেখা, দিদার হাতে বোনা সোয়েটার পরে ছাদে স্কিপিং করা – এগুলো বহুকাল হয়ে ওঠেনি ওর। এখন তো কলকাতার শীতে দুপুরে গরম জামা পরে বেরোলে ঘাম দেয়। পৌষ সংক্রান্তিতে প্রতি বছর দিদার বাড়ি নেমন্তন্নের দিকে মুখিয়ে থাকত ও – পাটিসাপটা থেকে শুরু করে চষির পায়েস, রাঙা আলুর পান্তুয়া, কী না বানাত দিদা ওদের জন্য, আর সঙ্গে অবশ্যই থাকত নলেন গুড়ের কড়াপাক সন্দেশ আর রসগোল্লা। ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোটামুটি দশ মিনিটে রেডি হয়ে নিল ও। এই অবেলায় সল্টলেক থেকে উজিয়ে সন্তোষপুর পৌঁছতে হলে অফিস টাইমের আগেই ওকে বেরোতে হবে। বেরোবার সময় দেখল বাবা যথারীতি ড্রয়িংরুমে বসে তারস্বরে টিভিতে সিনেমা দেখছে,এখন ডাকলেও শুনতে পাবে না। মা কে খুঁজতে গিয়ে ও দেখল আজও বারান্দার ধাপে পা ঝুলিয়ে বসে উদাস হয়ে ফাঁকা রাস্তা দেখছে। কিছু বলতে গিয়েও শুধু “মা, আসছি,” বলে গাড়ির চাবিটা নিয়ে গ্যারাজে গেল ও।
সল্টলেক থেকে বেরিয়ে বাইপাসে পড়ে একটু ভাবার সময় পেল ঈশানী। মাকে নিয়ে যে কী করা যায় সেটা কিছুতেই ওর মাথায় আসছিল না। ছ’মাস আগে ওর ডিভোর্সটা হওয়ার সময় থেকেই মা কীরকম একটা যেন হয়ে গেছে। মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি বিচ্ছেদটা। মার ধারণা ও আরেকটু চেষ্টা করলে শুভদীপের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারত। ব্যাপারটা যে অত সহজ নয় সেটা অনেক বলেও মাকে ও বোঝাতে পারেনি। শুভদীপের কথা মনে পড়তেই এত সুন্দর ঝকঝকে নীল শীতের দুপুরটা তেতো হতে লাগল। জীবনে এই একটাই ভুল করেছিল ঈশানী। তবে ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ডিভোর্সের রেশটা খুব তাড়াতাড়ি কাজের মধ্যে ডুবে গিয়ে কাটিয়ে ফেলবে। কাজ বলতেই বোধহয় টেলিপ্যাথি, পাশের সীটে রাখা ফোনটা বেজে উঠল। সুমিতদা। কানে লাগানো ব্লুটুথ-এর কুট্টি যন্ত্রটা চালিয়ে দিল ঈশানী।
“কী রে, কদ্দুর?”
“চিংড়িহাটায়, ট্র্যাফিক জ্বালাচ্ছে। পৌঁছে যাব, চাপ নিয়ো না।”
“ঠিকানাটা মনে আছে তো? চিনতে না পারলে ফোন করে নিস।”
“ঠিক হ্যায়, বস।”
ফোনটা কেটে একটু হাসিই পেল ঈশানীর। সুমিতদাকে টেকনিকালি ওর বসই বলা যায়, কিন্তু সেটের বাইরে লোকটা এতই ফক্কড় যে ওকে বস বলে মনেই হয় না। বর্তমান বাংলা সিনেমার অন্যতম নায়ক সুমিত বোসের পরিচালক হিসেবে দ্বিতীয় ছবিতে চিত্রনাট্য লিখছে ঈশানী। গত এক বছর ধরেই লেখা চলছিল, এখন তার শেষ পর্যায়ে ঘষামাজা হচ্ছে। এই ছবিটা উৎরে গেলে চাকরিটা ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চিত্রনাট্যই লিখতে চায় ও। গত ছ’বছরে দুটো পত্রিকাতে সাংবাদিকতা এবং কলামনিস্টের কাজ করেছে, সেই সুবাদেই বিভিন্ন অভিনেতা এবং পরিচালকের সাথে আলাপ হয়েছিল। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে দু-চারটে ছোট গল্প আর নাটকও লিখেছিল, যার কয়েকটা ছাপাও হয়েছিল। চিত্রনাট্যের নেশাটা ওর বহুদিন ধরেই ছিল, একটা ডিপ্লোমা কোর্সও করেছিল সেই বিষয়ে। বছরখানেক আগে সাহস করে সুমিতদার কাছে গিয়ে ও বলেছিল চিত্রনাট্য লিখতে চাওয়ার কথা, কিছু ড্রাফটও দেখিয়েছিল। একজন আনকোরা লেখককে এসব কাজ কেউই দিতে চায় না সহজে। সুমিত বোস নিমরাজি হয়ে কিছুদিন ওকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু লেখায় ঈশানীর স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতা দেখে নিজের ছবির কন্ট্র্যাক্টটা সুমিত ওকেই দেয়। সেইথেকে পুরোদমে কাজ চলছে। ঈশানীর চাকরিটা এখন অনেকটাই ফ্রীলান্সের পর্যায়ে চলে এসেছে। আরো কয়েকটা স্ক্রিপ্টের কন্ট্র্যাক্ট পেলে চাকরিটা ও ‘জয় মা’ বলে ছেড়েই দেবে।
বাইপাস থেকে সন্তোষপুর অব্দি এসে সার্ভে পার্কে ডানদিক নিল ও। আর সেই সময়েই বিকেলটা ঝুপ করে সন্ধ্যেতে পালটে গেল। ঠিকানাটা এইবার লোককে জিজ্ঞ্যেস করতেই হবে মনে হচ্ছে। ঈশানীর দরকার একটা পুরনো দোতলা বাড়ি যেটা নাকি সুমিতদার কোন প্রবাসী বন্ধুর। ওদের চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে বাড়িটা খাপ খাবে বলে সুমিতদার ধারণা। তাই ল্যাপটপে স্ক্রিপ্ট বগলদাবা করে ঈশানী এসেছে বাড়িটা দেখতে। যদি বাড়িটা ওদের ঠিকঠাক মনে হয় তাহলে এখানে বসে চিত্রনাট্য অনুযায়ী টুকটাক ঘষামাজাও হয়ে যাবে আর আর সম্ভাব্য শ্যুটিং লোকেশন হিসেবে এবাড়ির লোকদের সাথে কথাও হয়ে যাবে। রাস্তার নাম ধরে এগোতে এগোতে ঈশানী দেখল চারপাশে সবই নতুন নতুন হালকা বাংলো স্টাইলের একতলা-দোতলা বাড়ি। এর মধ্যে দু-একটা পুরনো বাড়ি থাকলে একেবারেই চোখে পড়ে যাওয়া উচিত। তবে এখানেও প্রতিটা গলির ভেতরে তস্যগলি আছে, যেগুলো ওকে বেশ ধাঁধায় ফেলে দিচ্ছে। ডাহা দাঁড়িয়ে বিড়ি ফোঁকা একজন অটোওয়ালাকে ঠিকানাটা জিজ্ঞ্যেস করল ও। অটোওয়ালা বোধহয় গাড়ি চালানো মামণি বেশি দেখেনি, তড়িঘড়ি বিড়িটা ফেলে এগিয়ে এল। আরো দুটো পারপেন্ডিকুলার গলি পেরিয়ে অবশেষে বাড়িটার সামনে পৌঁছল ঈশানী। সন্ধ্যের আগে পৌঁছতে পারলে বাইরে থেকে বাড়িটাকে ভাল করে দেখে রাখা যেত। তবে আবার একদিন আসতে হবে ক্যামেরাম্যান পার্থদাকে নিয়ে, তখন নাহয় দেখে নেবে। পার্থদার মেয়ের জ্বর বলে আজ আসতে পারেনি। এদিক ওদিক তাকিয়ে সুমিত দার ড্রাইভার রাজুকে গাড়ি সমেত দেখতে পেয়ে নিজের গাড়িটাও পাশের খালি জমিতে পার্ক করিয়ে নিল ঈশানী। রোজ গাড়ি চালালেও পার্কিংয়ে ওর বড়ই অনীহা। বাড়িটার সদর দরজা আর বাইরের গ্রিলের গেটের মধ্যে মোটামুটি সাইজের একটা বাগান চোখে পড়ল ওর। তবে এবাড়ির কেউ নিশ্চয়ই খুব যত্ন করে বাগান করে, শীতের ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকারেও বড় বড় সাদা গোলাপগুলো পরিষ্কার ফুটে রয়েছে। সদরে পৌঁছে বেলটা বাজাল ও।
একজন মধ্যবয়স্ক চাকর গোছের লোক এসে দরজাটা খুলে দিল। কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ দেখে বোধহয় লোকটা বুঝেছে ওরই আসার কথার ছিল, কারণ সে ওকে কিছুই জিজ্ঞ্যেস করল না। পুরনো লাল পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলায় টানা বারান্দার একদম শেষ ঘরটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বোধহ্য় সে নিজের কাজে চলে গেল। যেখানে ঈশানী দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে বারান্দাটা এল-শেপে এগিয়ে গেছে। বারান্দার একপাশে সারি দিয়ে গোটা পাঁচেক ঘর আর তার উল্টোদিকটা পুরনো দিনের লোহার কারুকাজ করা রেলিং দিয়ে ঘেরা। এগোতে এগোতে ও দেখল ঘরগুলোর অধিকাংশই দরজা বন্ধ, একটাতে ভারী পর্দা ঝুলছে একেবারে চৌকাঠ পর্যন্ত আর শেষের ঘরটার পর্দা খানিকটা সরানো, সেখান দিয়ে আলো এসে পড়ছে সামনের মেঝেটায়। এগিয়ে গিয়ে ঠিক সেখানটায় দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরে তাকাল ঈশানী। সামনেই একটা বিশাল সোফাতে বসে নিজের পেটেন্ট অট্টহাসিটা দিচ্ছে সুমিতদা। খোলা দরজায় নক শুনে হাসি থামিয়ে ওকে দেখে উঠে এল,
“এইমাত্র তোকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম অন্ধকারে হারিয়ে গেলি বোধহয়। আয়, ভেতরে আয়।”
ঘরের ভেতর ঢুকে ল্যাপটপটা মেঝেতে রেখে উল্টোদিকের সোফায় বসা ব্যক্তিকে দেখে ঈশানী কয়েক মূহুর্তের জন্যে পাথর হয়ে গেল। ওকে দেখে সোফা থেকে যে উঠে দাঁড়িয়েছে তাকে যে আবার কোনোদিন দেখতে পাবে সেটা ও একবারও ভাবতে পারেনি। পাশে সুমিতদা নিজের মনে বলে চলেছে,
“ঈশানী, এই আমার বন্ধু আর্য। এটা ওদেরই বাড়ি, তবে ও থাকে জার্মানিতে। কাকু কাকিমা এখনো এখানেই থাকেন।”
ঈশানী কিছু শুনতে পাচ্ছিল না, ওর কাছে শীতের সন্ধ্যেটা পালটে গিয়ে দারুণ গ্রীষ্মের দুপুর হয়ে যাচ্ছিল। নিষ্পলকে আর্যদার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর কাঁপুনি আসছিল। সেই চোখ, সেই চওড়া কপাল, ডান গালে সেই ছোট্ট টোলটা, হাতের লম্বা লম্বা আঙুলগুলো, যা সব একসময়ে ওর ছিল,সেগুলো আজ আস্তে আস্তে আবার ওর সামনে ফুটে উঠছিল। এত বছর ধরে ওর মনে আর্যদার একটা নির্যাস জমে ছিল কানাভরা দীঘির মত। কখনো তার থেকে ওই চোখগুলো, কখনো টোলটা, কখনো লম্বা আঙুল দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরা হঠাৎ হঠাৎ উঁকি মারত। আজ গুনে গুনে ছ’বছর পর আবার ও সেই মানুষটাকে চোখের সামনে পরিপূর্ণভাবে দেখতে পেল। এই মূহুর্তে ঘরের ভেতর কফির ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে যে শূন্যতা ওদের চারপাশে ঘুরছে, তা যেন পুরু দেওয়াল ভেদ করে বাইরের পৃথিবীতে পালাতে চাইছিল। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়েছিল জানেনা ঈশানী। সম্বিত ফিরতে দেখল সুমিতদা ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে,
“কি রে, কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন? তোরা কি একে অপরকে চিনিস নাকি?”
কী উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে ঈশানী মন দিয়ে চোখ আর চশমা মুছতে লাগল।
“হ্যাঁ, চিনতাম।”
বহুদিন পরে আর্যদার গলা শুনে দু’সেকেন্ডের জন্যে ওর হৃদস্পন্দন থেমে গেল। আশ্চর্য্য, এতদিন এতকিছুর পরেও এই চেনা গলা শুনলে ওর ভেতরটায় এরকম হয়?এই জন্যেই কি ওর বিয়েটা টিকল না? কিন্তু ও তো শুভদীপকে নতুন করে ভালবাসতে শুরু করেছিল আর্যদাকে মনের এককোণে তালাবন্ধ করে রেখে। আর এতদিন পরে আর্যদা কী অবলীলায় ‘চিনতাম’ বলল। সবকিছু কি পাস্ট টেন্স হয়? ঈশানী হলে বলত, ‘চিনি।‘ কিন্তু ও কি সত্যিই এখনো চেনে আর্যদাকে, যে ওকে ছ’বছর আগে কেন ছেড়ে গিয়েছিল সেটা ও আজও জানে না। কয়েক মাসের জন্যে ও একটা স্থায়ী হতভম্ব অবস্থায় ছিল, হঠাৎ শক পেলে মানুষের যেরকম হয়। বাড়িতে, কলেজে, ট্যুইশনে, দোকানে, বিয়েবাড়িতে – সবজায়গায় ও গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। প্রাণবন্ত মেয়েটার এই অকস্মাৎ পরিবর্তন দুনিয়াসুদ্ধ লোকের চোখে পড়েছিল। ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার চাপ বলে সবার প্রশ্ন কাটিয়ে দিয়েছিল ও সেই সময়ে। প্রতি রাত্রে ঘুমোবার সময়েই একমাত্র নিজের সঙ্গে একা হওয়ার সময় পেত ঈশানী। আর একা হলেই ওর ভেতর থেকে আর্যদার নির্যাসটা আস্তে আস্তে রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়ে তোলপাড় শুরু করে দিত। চার বছর ধরে ও ধীরে ধীরে খুব যত্ন করে জীবনে প্রথমবার কাউকে ভালবেসেছিল। যতদিন আর্যদা কলকাতায় ছিল, সব ঠিকই চলছিল। তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরি পেয়ে চেন্নাই চলে গেল। দুরত্বটা ঈশানীর কাছে কোনোদিনই সেরকম বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ততদিনে বাবার থেকে ওর একটা মোবাইল ফোন প্রাপ্তি হয়েছিল আর মাকে ও আর্যদার কথা বলেছিল। দেড় বছর পর আর্যদা অনসাইট পেয়ে জার্মানি চলে গেল, যাওয়ার আগে কলকাতা এসে ঈশানীকে ওর জীবন থেকে উপড়ে ফেলে দিয়ে গেল। সেই দিনটা ওর আজও মনে আছে আর বোধহয় সারাজীবন থাকবে।
“তোদের কেসটা কী বল তো? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। আর্য তো এতদিন জার্মানিতে ছিলি, ঈশানীও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িসনি। তাহলে তোদের আলাপটা হল কোথায়?”
“সল্টলেক।”
আর্যদার এত কম কথায় উত্তর দেওয়ার স্বভাবটা এখনও যায়নি তাহলে? ঈশানী অবাক হয়ে ভাবছিল যে ওর চেনা, ওর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা পুরোপুরি বদলে যায়নি এখনও। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও ওর ভেতরটা একভাবে কেঁপেই যাচ্ছিল। ডিভোর্সটা হয়ে একদম একা হওয়ার পর থেকেই আর্যদার কথা আরো বেশি করে মনে পড়ত ওর। ছ‘বছর দেখা না হয়ে পুরো চেহারাটা মনে মনে ও কিছুতেই বানিয়ে উঠতে পারছিল না। ফেসবুকেও অনেক খুঁজেছিল ও, কোথাও পায়নি আর্যদাকে। সার্চ অপশনটা বোধহয় বন্ধ করে রেখেছিল ঈশানীকে একেবারে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে।
“ওহ হো, তোরা তো সল্টলেকে চলে গিয়েছিলি কয়েক বছরের জন্যে, এখানে বাওয়ালি হয়েছিল বলে। আর ঈশানীর বাড়িও তো সল্টলেকে। কিন্তু এই কান্নাকাটির কেসটা কী?”
“কিছু না।” আর্যদা কি ওকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে চায় সকলের কাছে?কিন্তু…তাহলে তো চেনে না বললেই ঝামেলা মিটে যেত।
“কিছু না মানে? আমি কি গাধা নাকি? শোন, তোকে আমি সেই স্কুল থেকে চিনি। যতই তুই জার্মানি-ফার্মানিতে থাক না কেন, এখনও একটুও পাল্টাসনি। ঈশানী তো মৌনব্রত নিয়েই নিয়েছে, মনে হচ্ছে আমার সিনেমাটা মাঠে মারা যাবে। তুই তো অন্তত কিছু বল, আর্য।”
ঈশানী চশমাটা এখনো হাতে ধরে ওর বড় বড় চোখ দুটো দিয়ে সুমিতদার দিকে তাকাল। যেন ও চোখ দিয়েই প্রশ্নটার উত্তর দিতে চায়। সুমিতদা কি এখনও বুঝছে না, এত বছর পর দুই তরুণ-তরুণীর দেখা হলে তাদের ভেতরে-বাইরে চোখের জল কেন বয়ে যায়। এই বুদ্ধি নিয়ে লোকটা কী ঘন্টা সিনেমা বানাবে কে জানে! অল্প অল্প রাগ হচ্ছিল ওর। সুমিতদা এখানে এমন জেদ করছে, কী বলবে, কেন বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না ও। সত্যিটা বলাই যায়, কিন্তু আশপাশ থেকে যদি আর্যদার বউ-বাচ্চা, নিদেনপক্ষে কাকু-কাকিমাও শুনে ফেলেন? ও আদৌ বিয়ে করেছে কিনা জানেনা ঈশানী। যদি করে থাকে, ওর বউয়ের সামনে কেঁদেকেটে আজ অপ্রস্তুত হতে চায় না প্রাক্তন প্রেমিকা। মনটা শক্ত করে ঈশানী ঠিক করল এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে এই মূহুর্তে। আর্যদার সামনে বেশিক্ষণ থাকলে ও প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়বে। আর্যদা এতক্ষণে ওর সাথে একটাও কথা বলেনি, অকারণ এখানে থেকে কষ্ট বাড়িয়ে কী লাভ হবে? চশমাটা পরে ও সুমিতদাকে বলতে গেল যে ও বেরিয়ে যাচ্ছে। তার আগেই আর্যদা বলল,
“আমি ওকে ভালবাসতাম।”
দুজনে একসঙ্গে ঈশানীর দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে, চশমার ফাঁক দিয়ে চোখের জল গড়িয়ে ওর ডিজাইনার স্টোলটা ভিজিয়ে দিচ্ছে।
কথাটা শোনামাত্রই ঈশানী কেন চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল ও জানে না। এত বছর পর আর্যদার মুখে কথাটা শুনে ও কিছুই ভাবতে পারছিল না। মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গিয়ে কথাটা খালি দেওয়ালে ঠোকর খেয়ে বুমেরাংয়ের মত ফিরে আসছিল,
‘আমি ওকে ভালবাসতাম।‘
‘আমি ওকে ভালবাসতাম।‘
আশ্চর্য্য, আবার সেই পাস্ট টেন্স। আজ বোধহয় ঈশানীর অতীতে ফিরে যাওয়ার দিন।
আস্তে আস্তে চোখ খুলে ও দেখল সামনে দুজন পুরুষ চুপটি করে ওর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে, ওকে সময় দিচ্ছে। চোখটা আবার মুছে মনের জোর সঞ্চয় করে খুব আস্তে ও বলল, “আমি…যাই।”
সুমিতদা এগিয়ে এসে আলতো করে ওর কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বলল,
“আমি ওঘরে কাকিমার সাথে দেখা করে আসি, তোরা একটু কথা বল।”
বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে ঘরের পর্দাটা পুরো টেনে দিয়ে গেল সুমিতদা। এ ঘরের সমস্ত আলো আর উষ্ণতা এখন ওদের দুজনকে ঘিরে আছে। সাহস করে আবার আর্যদার দিকে তাকাল ঈশানী। ও কথা বলুক আর না বলুক, ওর দিকে চেয়ে থাকার অধিকারটুকু ঈশানীর আজও আছে নিশ্চয়ই। একটু এগিয়ে এসে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর্যদা জিজ্ঞ্যেস করল,
“কেমন আছিস?”
যে প্রশ্নটা আগে ওর ঠোঁটে এক চিলতে মিষ্টি হাসি এনে দিত, আজকে সেটা শুনে ওর চোখে আবার জল এল। ঠোঁট চেপে ঈশানী ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইল সামনে। আর্যদা আরেকটু এগিয়ে একদম ওর সামনে এসে বলল,
“কথা বলবি না?”
কোনো একটা বিদেশি পার্ফ্যুমের গন্ধ পেল ঈশানী। আর্যদা চিরকালই ফিটফাট থাকত, এখনো আছে। জোর করে চোখ নাক মুছে, স্টোলটায় কাজল ধেবড়ে একটু হাসার চেষ্টা করল ও,
“বলো।”
“কেমন আছিস?”
কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না ঈশানী। কেমন আছে ও নিজেই জানেনা ঠিক করে। হাসপাতালের বেড থেকে রুগীদের মত চিঁ চিঁ করে বলল,
“ভালোই।”
“তোর সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।”
‘আমার সাথে কি আর আদৌ কোনোদিন তুমি দেখা করতে চেয়েছিলে?’ মনে মনে বলল ঈশানী। মুখ ফুটে এটা ও কিছুতেই বলতে পারল না। এই একটা সম্পর্কের অবসানেই নিজের সব প্রগলভতা হারিয়েছে ও। শুভদীপ তো সবসময়েই ওকে চাপা আর ইন্ট্রোভার্ট মনে করত, অথচ তার আগে অব্দি এই মেয়ে কথার ফুলঝুরি ছিল। একজন ব্যক্তির সঙ্গে থাকা বা না থাকা যে অন্যজনের স্বভাবে বদল এনে দিতে পারে সেটা ঈশানী নিজেকে দেখে বুঝেছে। আর আজ সত্যিই ওর মুখে কথা সরছে না আর্যদার সামনে।
“তুই এত চুপচাপ কবে থেকে হয়ে গেলি? নাকি আমার সাথে কথা বলবি না?”
“কী বলব?”
এবার আর্যদার চুপ করার পালা। ছ‘বছর আগে ও যেভাবে চলে গিয়েছিল তাতে ঈশানী এখন ওর সাথে কথা না বলতে চাইলে আশ্চর্য্যের কিছু নেই।
“তুমি আমাকে ছেড়ে কেন চলে গিয়েছিলে?” চোখের জল চাপার আর কোনো চেষ্টাই না করে ঈশানী বলল। এতদিনের বাঁধ ভেঙে গিয়ে আর আজ কোনো কিছুই বাধা মানছিল না।
“আমার ভুল হয়েছিল রে, জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছিল ওটা। যতদিনে বুঝলাম, তোর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।”
“যদি না হত, কী করতে?”
“ছাড়। সুমিত বলল তুই সল্টলেকেই থাকিস।”
“হ্যাঁ, পুরনো বাড়িতে। ছ‘মাস আগে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে।”
কথাটা শুনে আর্যদা চাবুক খাওয়ার মত চমকে তাকাল ওর দিকে।
“আমি কিন্তু চেয়েছিলাম তুই ভাল থাকিস যে কোনোভাবেই।”
“আমি এখনই ভাল আছি, বিয়ে্টা করা উচিত ছিল না।”
যে কথাটা ঈশানীর জানতে খুব ইচ্ছে করছিল যে আর্যদা কী করেছে, সেটাও ও জিজ্ঞ্যেস করে উঠতে পারল না। শুধু তাকিয়ে রইল ওর চোখের দিকে। সেই চোখ, যা দেখেই ও প্রেমে পড়েছিল।
ঈশানীরা সল্টলেকের পুরনো বাসিন্দা, ওর বাবা চাকরিজীবনের শুরুর দিকেই ওখানে বাড়ি বানিয়েছিলেন। ও যখন ক্লাস টুয়েলভে পড়ে, আর্যদারা ওদের পাড়ায় একজন প্রবাসী ভদ্রলোকের ফাঁকা বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে আসে। ওরা বাবা-মা-ছেলে তিনজনেই খুব শান্ত, চুপচাপ প্রকৃতির ছিল, নতুন পাড়ায় কারুর সাথে বিশেষ মিশত না। ঈশানী যাতায়াতের পথে, বাস স্ট্যান্ডে, অটোতে আর্যদাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। তারপর একদিন রাস্তায় ধরে আলাপ করে ফেলল। আস্তে আস্তে দুজনের বন্ধুত্ব হল, মূল উদ্যোগটা অবশ্য ঈশানীরই ছিল। শুরুতেই দিশেহারার মত ও আর্যদার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু অনেকদিন সেটা প্রকাশ করেনি। ক্রমশ একে অপরের বাড়িতে যাতায়াত শুরু হল, কাকু-কাকিমাও ঈশানীকে খুব পছন্দ করতেন। মা বাবারা মোটামুটি আঁচ করতে শুরু করেছিলেন ব্যাপারটা কী ঘটছে, যদিও পাড়ায় ওদের বেশিক্ষণ একসঙ্গে দেখা যেত না। আর্যদা বলেছিল যে ওরা পৈতৃক বাড়িতে শরিকি গোলমালের জন্যে সল্টলেকে বাড়িভাড়া নিয়ে চলে এসেছে, কিন্তু এর বেশি কিছু ও বলতে চাইত না,ঈশানীকে কোনোদিন সেখানে নিয়ে যাওয়ারও প্রশ্ন ছিল না। নিজেদের বাড়ি,নিজের ঘর, নিজের ছোটবেলা থেকে বেরিয়ে এসে আর্যদা খুব মনমরা হয়ে থাকত প্রথম প্রথম। ঈশানীর সান্নিধ্যে এসে আস্তে আস্তে আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। চেন্নাই গিয়ে কার সান্নিধ্যে ঈশানীকে ভুলে গেল কে জানে!
“তুই কী ভাবছিস আমি জানি। আমি এখনো বিয়ে করিনি, যদি তুই এটাই জানতে চাস।”
“আমিও কখনই চাইনি তুমি খারাপ থাকো, কিন্তু আমি আজও জানিনা তুমি কেন চলে গিয়েছিলে।”
“চেন্নাইতে আমার এক কোলীগ ছিল। একই টিমে কাজ করতাম, বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। সেই আমাকে বোঝায় বিদেশে গিয়ে লং ডিসট্যান্স সম্পর্ক টেঁকে না। আমি কেন জানি তাকে বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম, তার কথায় তোকে ইমম্যাচিওর ভেবেছিলাম। তোর থেকে দূরে ছিলাম বলে হয়তো অন্য লোকের কথা অত সহজে মেনে নিয়েছিলাম। জার্মানি গিয়ে আমরা একসঙ্গেই ছিলাম, যদিও পরে সে আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি, কারণ তাকে আমি কোনোদিন ভালবাসিনি সেভাবে। ওটা একটা ইনফ্যাচ্যুয়েশন ছিল। ছ‘বছরে এই দ্বিতীয়বার কলকাতা এলাম, তাও আগের বার এসেছিলাম ঠাকুমা মারা গেলেন বলে। বাবা মাকে দুবার জার্মানি নিয়ে গিয়েছিলাম, আমি এখানে আসিনি একবারও। আগে আসতাম না এই অপরাধবোধে যে তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে কী বলব। এখন আসি না কারণ তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে কিন্তু তোর বিবাহিত জীবনে আমি কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি।”
“এবার কেন এলে?”
“কদিন আগে বাবার বাইপাস সার্জারি হল, মা একা ভরসা পাচ্ছিল না, তাই চলে এলাম।”
“আমার সাথে দেখা করোনি তো।”
“ওই যে বললাম, আমি চাইনি তোর সংসারে আমার জন্যে অশান্তি হোক।”
“আর সংসার!”
“কী হয়েছিল?”
“পোষায়নি।”
অনেকটা দ্বিধা আর সংকোচ নিয়ে আর্যদা বলল,
“একটা কথা বলব, বিশ্বাস করবি?”
“বলো, এত হেজিটেট করছ কেন?”
“আমি কখনোই তোকে ছাড়া কাউকে ভালবাসতে পারিনি। এখনো আমি তোকেই ভালবাসি।”
পাস্ট আর প্রেজেন্ট টেন্স গুলিয়ে যাচ্ছিল ঈশানীর। সত্যি, মিথ্যে, বর্তমান,অতীত কিছুই তাহলে স্থায়ী নয়, প্রতি মূহুর্তে জীবন পালটে যেতে পারে।
“তুই কি আবার দেখা করবি আমার সাথে?”
“জানিনা। হয়তো করব। হয়তো নয়। আমার নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে এখনো।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কিন্ত সেই আগের মত উজ্জ্বল চোখে আর্যদা তাকাল ওর দিকে।
“কী জানো, বহু বছর আগে তোমাকে দেখার কোনো এক মূহুর্তে আমার মনে কে যেন বলেছিল, ঈশানী, এই ব্যক্তিই তোমার নিয়তি। সেটা ঠিক না ভুল, সেই সিদ্ধান্তটা নিয়তিই নিক এখন। ততদিন, বা আদৌ কোনোদিন কি তুমি অপেক্ষা করবে আমার জন্যে?”
ঈশানী আর কাঁদছিল না। হয়তো ঈশানী আর কাঁদবে না।
Bartajogot24
September 28, 2019 at 2:28 PM
Sundor! Best wishes for you!
click here
Kolikataherbal
December 9, 2019 at 5:18 PM
bah! Besh hoycehe lekhata. Thank you.