পুণেতে এসে নতুন বাসা খুঁজে সেখানে বসবাস শুরু করার আগেই মনে মনে খুব জরুরী একটা জিনিস চাইছিলাম। জিনিস বললে অবশ্য ভুল বলা হয়। এই দৈনন্দিন চাহিদাটি বাড়িতে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। শহুরে পশ্চিমবঙ্গের নব্বই শতাংশ বাড়িতেই কাকভোরে বা একটু বেলায় আপিস টাইমে যাঁদের ব্যস্ততা সবচেয়ে বেশী থাকে, তাঁরা স্কুল-কলেজ-অফিসযাত্রী নন – কাজের মাসি। তাঁদের কেউ কেউ ট্রেনে আসেন (দক্ষিণ কলকাতায়), কেউ পাশের বস্তিতে থাকেন (উত্তর কলকাতায়), কেউ বা বাসে-অটোতেও যাতায়াত করেন। আমাদের হায়দ্রাবাদের বাসায় কাজের মাসি ইন-হাউজ ছিলেন, অর্থাৎ সেখানকার কেয়ারটেকারের স্ত্রী। পুণেতে এসে কপালে কে জুটবে সেই নিয়ে যারপরনাই চিন্তায় ছিলাম।
আনকোরা নতুন ঘরে প্রথম দিন ঝাড়ু-ফিনাইল-বালতির দোকান খুলে বিশাল ধোয়াধুয়ি করছি, হঠাৎ বেল বাজল। দরজার ওপারে এক প্রৌঢ়াগত তরুণী, নিঁখুত কুঁচি দিয়ে পাট করে শাড়ি পরা, গলায় সোনার মঙ্গলসূত্র, হালকা সিঁদুর, হাতে পার্স ও মোবাইল। সেলসগার্ল ভেবে কাটিয়ে দেব মনে করছি, তার আগেই তিনি বললেন যে আমরা নতুন এসেছি, কাজের লোকের দরকার থাকলে তিনি করতে চান। দেখেশুনে যত না চমকালাম, তার চেয়েও বেশি চমক অপেক্ষা করছিল যখন তিনি কাজের রেটগুলো বললেন – প্রতি কাজ (অর্থাৎ বাসন মাজা, ঘর মোছা, কাপড় কাচা) ৫০০/- । ভাবা যায়! পশ্চিমবঙ্গের কাজের মাসি-মেসোরা শুনলে মুচ্ছো যাবেন। আমারই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগাড় হওয়াতে তাঁকে বললাম পরে কখনো আসতে। উদ্দেশ্য পাতি ছিল, একটু মার্কেট সার্ভে করে নেওয়া, যদি পকেট কিঞ্চিৎ বাঁচানো যায়। তবে সেটা হল না, কারণ বাকিদের রেট একই থাকলেও প্যাখনা দেখলাম অনেক বেশি এঁর থেকে। সেদিন থেকে ইনি বহাল হলেন এবং আমারও জীবনের একটা নতুন অভিজ্ঞতার সূচনা হল।
ভূমিকায় বলেছিলেন বাড়িতে বর আর দুই ছেলে আছে, সোলাপুরের কাছে এক গ্রামে নিবাস, ইত্যাদি। মাসখানেক নির্বিঘ্নে কাজ করলেন, রোজই দেখি সকাল সাতটা নাগাদ আসেন, দুপুরবেলা বাড়ি গিয়ে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে আবার এসে কয়েক বাড়ি রান্না করে প্রায় রাত নটায় বাড়ি ফেরেন। এতটা কর্মক্ষমতা দেখে আমরা বেশ খানিকটা অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। নিজের বাড়ির কাজ, দুটো বাচ্চা আর বরের দেখাশোনা সেরেও কি কেউ বারো ঘন্টা খাটতে পারে? অমানুষিক ক্ষমতার সঙ্গে বীভৎস টাইম ম্যানেজমেন্ট না হলে সম্ভব নয়। তা সে যাইহোক, এই হুব্বা-ভাব নিয়ে আমরা তাকে দেড় মাসের ছুটি দিলাম। আমার বেটার হাফ গেল লন্ডনে অফিসের কাজে আর আমি গেলাম কলকাতা। মাসি অর্ধেক মাইনে নিয়ে কাজটা হাতে রাখলেন। ইন ফ্যাক্ট, তাঁর নাকি আমাকে এত পছন্দ হয়েছে যে মাসখানেক এর মধ্যেই পুণে থেকে কলকাতা এসটিডি কল করে কুশল নিলেন! বিশ্বাস করুন, আজ অব্দি কোনো কাজের মাসি আমার এত খবর নেননি। হায়দ্রাবাদের মাসি ঘোর সংসারী ছিলেন, দুটো মেয়ে, অপোগন্ড বর এবং ছোট ভাইকে সামলে আর কারুর খোঁজ নেওয়ার তাঁর সময় হত না।
দেড়মাস পর ফিরে এসে আবার সংসারযুদ্ধ শুরু করলাম। মাসিও খুশিমনে নতুন উদ্যমে কাজ করতে লাগলেন। দিনকয়েক পরে লন্ডন-আনীত কিছু চকলেট তাঁকে দিতে গেলাম বাচ্চাদের নাম করে। তাতেই দেখলাম মাসি কিঞ্চিৎ চুপসে গেলেন। দিনটা ছুটির ছিল, গুছিয়ে বসলেন রামকাহিনী শোনাতে। যা শুনলাম তাতে আমরা আরো হুব্বা হয়ে গেলাম। মাসি বললেন, পুণেতে তাঁর বর-ছেলেরা কেউ নেই, তারা গ্রামে। এখানে তিনি একা থাকেন, বরের সাথে সেপারেশন। ষোলো-সতেরো বছর বয়সে যখন তিনি এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের প্রেমে হাবুডুবু, বাড়ি লোক জোর করে তাঁর বিয়ে দেয় এক মাতালের সাথে। মাসি অনেক বছর ঘর করলেন, দুটি পোলা হল, বর আরো মাতলামি করে তাঁকে পিটিয়ে ধামসে দিল। শেষমেশ আর থাকতে না পেরে তিনি বরকে ত্যাগ দিয়ে পুণে চলে এলেন প্রাণ বাঁচাতে। বর হারামজাদা তার ছেলেদের ছাড়েনি বংশরক্ষার দায়ে। মাসি এখানে এসে কাজ খুঁজে অনেক কষ্টে একা থাকতে শুরু করলেন। তাঁর নিজের দাদাও তাঁকে মেরে পা ভেঙে দিয়েছিল বরকে ছেড়ে আসার জন্যে, তাদের বোধহয় গ্রামে সম্মানহানি হয়েছিল।
এইসব প্রতিকূলতা পেরিয়ে এক বাঙালি বাড়িতে অল্প টাকায় কাজ শুরু করেন মাসি। সেখান থেকে আস্তে আস্তে এক কামরার ভাল ঘর ভাড়া নিলেন, একটু একটু করে টাকা জমিয়ে এখন স্কুটার কিনেছেন যাতায়াতের জন্যে। আট-নয় বছর কাজ করে টাকা জমিয়ে নিজের জন্যে দামী গয়নাও বানিয়েছেন, একটা নাহয় অ্যাসেট রইলই শেষ বয়সের জন্যে। একা থাকতে তাঁর খারাপ লাগে না, স্বাধীনতা আর স্বাবলম্বীতা তাঁর কাম্য ছিল। তবু কাজের ফাঁকে একেকদিন তাঁর মনে শীত আসে, মনটা ঠান্ডা হয়ে জমে যায়, গলার আওয়াজ মিউট হয়ে যায়। যাদের কথা মনে পড়ে তারা কেউ কাছে থাকে না, ছেলেরা বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে গেছে, এখন হয়ত মাকে দেখলেও চিনতে পারবে না। তাঁর সম্বল নিজের রোজগারটুকু, আর প্রাক্তন প্রেমিকের একটু দেখাশোনা মাঝে মাঝে। প্রতিটা কাজের বাড়িতে ভরা পরিবার, স্বামী-স্ত্রী-বাচ্চা দেখে তাঁর কী মনে হয় কোনোদিন প্রকাশ করেননি। হয়ত একটু কাঁটা ফোটে, পরের দিন সেটুকু উপড়ে ফেলে আবার কাকভোরে কাজে আসেন।
পুনশ্চঃ যারা পুণে পাঁচালী ২ পড়েছিলেন, তাদের জানাই যে ভবা পাগলা এখনো একই উদ্যমে আবিষ্কার আর প্রত্যুষকে ডেকে যায় খেলার জন্যে। লাভের মধ্যে তার নামটা জানা গেছে – অভিষেক।
arandomstateofmind
December 10, 2013 at 10:52 PM
খুব ভালো লিখেছিস । মনটা একটু ক্যামন হয়ে গেল… 😦
শ্রীল শ্রীযুক্ত বাবু অভিষেক মুখোপাধ্যায়
December 11, 2013 at 3:02 AM
রাতবিরেতে এইসব লিখে ইমোশনল না করে দিলেই চলছিল না?
pridreamcatcher
December 11, 2013 at 3:32 PM
“এই তো জীবন, কালীদা।” মন খারাপ হলে চলবে?
Abhra Pal
December 11, 2013 at 8:35 PM
Kurnish!
Arijit Banerjee
December 12, 2013 at 9:55 AM
Daarun 🙂 aste aste tor lekhar fan hoye jacchhi
pridreamcatcher
December 12, 2013 at 10:00 AM
@arijit da: আস্তে আস্তে হচ্ছিস তাও ভালো, বেটার লেট দ্যান নেভারঃ)
Subhadip
December 14, 2013 at 6:42 PM
bhalo likhechhis. btw, proti kaaj 500 maane ki ghor mochha+bason+kapor = 1500 ? se khetre rate toh khub beshi noi re. Kolkata tei ghormochha+bason ekhon 800-1000
pridreamcatcher
December 18, 2013 at 11:40 AM
হ্যাঁ শুভদীপ-দা, সব মিলিয়ে ১৫০০
তুমি কলকাতার যে রেট বলছ, সেটা শুধু কিছু এলাকায়। যাদবপুরে আমাদের বাড়িতে কাজের মাসি দুটো কাজের জন্যে ৫০০ নেয়। একটু মফস্বলের দিকে গেলে আরো কম। আমি গোটা পশ্চিমবঙ্গ ধরে বললাম।
Rishi
March 9, 2014 at 4:08 AM
bhalo laglo apnar lekha pore, etao onekta horishe bishad mone holo
স্মৃতিলেখা চক্রবর্ত্তী
April 10, 2014 at 9:01 AM
আমাদের নবী মুম্বাই-তেও কাজের রেট এইই। বাঙ্গালী মাসিদের রেট আরেকটু বেশি।