RSS

কোরোনার দিনগুলিতে – ৫

19 May

গঙ্গা পদ্মা দিয়ে বহু জল বয়ে অবশেষে কোরোনার বর্ষপূর্তি হয়ে গেল দেশে দেশে। যে অতিমারীর প্রকোপ কমবে এমনটা আশা ছিল, তার জায়গায় দেশে বীভৎসাকার নিয়েছে এখন দ্বিতীয় ঢেউ। এ বছরের শুরুটা ভাল হবে ভেবেছিলাম, কিন্তু বিধি বাম। নাকি ডান? একাশি দিন টানা কলকাতায় শেষ কবে থেকেছি মনে নেই, গত এক দশকে তো নয়ই। ছুটি কাটানো আর এই আপদকালীন বসবাসের মধ্যে যে কী আকাশ পাতাল তফাত তা বোঝানো কঠিন। শোক, ত্রাস, স্বজন বিয়োগ ও কোভিডাক্রান্ত হওয়া – সব মিলিয়ে সে এক ভয়ানক ব্যাপার।

আপাতত দিন কাটছে শম্বুক গতিতে। গত এক মাস ধরে সোশাল মিডিয়াতে মৃত্যু মিছিল ও হাসপাতাল-অক্সিজেনের জন্য যে হাহাকার দেখছি, তা অবর্ণনীয়। প্রত্যেক দিন সকালে তবু দাঁতে দাঁত চেপে প্রযুক্তি ও তথ্যকে সম্বল করে বেশ কিছু মানুষ প্রাণপন চেষ্টা করে চলেছে বহু রোগীকে সাহায্য করতে। সেই কেবিসিতে ‘ফাস্টেস্ট ফিংগার ফার্স্ট’ মনে আছে? সোশাল মিডিয়াতে আবেদনগুলি এলেই এখন সেইভাবে রিসোর্স খুঁজতে হচ্ছে। দশ মিনিট দেরী হলেই বেড চলে যাচ্ছে অন্য কারুর কাছে, অক্সিজেন ফুরিয়ে যাচ্ছে, ওষুধের স্টক নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। একেকটা মুহূর্ত অসহনীয় লাগে প্রতিদিন।

ছবিঃ নিজস্ব

জীবনটা বর্তমানে যেমন, তেমনটা অবশ্যই চাই না। জীবন হোক – পাশের বাড়ির আড়াই বছরের শিশুটির মত, যে তিন দিন পর মলত্যাগ করলে তার বাবা বলে, “বাহ, সুন্দর হয়েছে,” – অথবা ওই একই শিশুটির বাবার মত, যে অতিমারীতে রুজি রোজগার ভুলে সকাল সন্ধ্যা শুধু ছেলেকে ‘ব্যানানা’ বা ‘ওয়াটার’ খাওয়ায় (ওই পটিরই আশায়) – অথবা, ওই শিশুটিরই মায়ের মত, যে আড়াই বছরের বালককে অসীম ও অলীক আশা নিয়ে জিজ্ঞ্যেস করে, “বাবু তুই বড় হয়ে আমাদের দেখবি তো?”

চারিদিকে মারণ ভাইরাস, ব্যাধি, মৃত্যু, বেকারত্ব তাদের খুব একটা স্পর্শ করে না। ঘরের সামনের ঢাকা বারান্দাটুকুতে তারা তাদের শিশুটিকে নিয়ে ছোট্ট সংসার বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বেশি ভাবে না বলেই হয়ত তাদের মনে এই দুশ্চিন্তা আসে না যে কদিন পরে ভাইরাসের থাবা তাদের ঘরের ছাউনিও উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। শিশুটি সকাল হলেই তার বাবার কিনে দেওয়া এক হাজার টাকা দামের ট্রাইসাকেলটিতে বসে স্যানিটাইজারের বোতল নিয়ে খেলা করে। তার দাদু, যিনি শিক্ষক ছিলেন, শিশুটিকে বলেন, “দেখি, Dog বলবা, বলো dog, তারপর বলবা cat।” অবসরে খবরের কাগজটি পড়ে মেয়েকে বলেন, “কাল থিক্যা আর গঙ্গার মাছ আনুম না, পুকুরের মাছ আনুম। গঙ্গার মাছে ভাইরাস পাওয়া যাইতে পারে।” শিশুটির বাবা একদিন ফোনে কাকে বলে দেয়, “কাল থেকে কদিন আমি কাজে বেরোব না, চারিদিকে কোরোনা, বাড়িতে একটা বাচ্চা আছে তো।” না চাইতেও বা না ভাবতেও কোরোনা কখন যে তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে যায়, সেটা তারা আর আলাদা করে বুঝতে পারে না।

আমার নিবাস এখন দুই বাড়িতে ভাগাভাগি করে, যেখানে যখন যেরকম কাজের প্রয়োজন, সেইমত। এক বাড়ির দিকের প্রতিবেশী শিশুটির গল্প বললাম ওপরে। অন্যদিকের বাড়িতে যখন থাকি, রোজ বিকেলে পাঁচতলার ছাদে উঠি কয়েক টুকরো জীবন প্রত্যক্ষ করার জন্য। কোনো ফ্ল্যাটের বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় টিভিতে সিরিয়াল চলছে, সোফায় বসা বৃদ্ধাকে চা এনে দিচ্ছেন বৃদ্ধ, আবার কোনও সুদূর কোণ থেকে ভেসে আসে সন্ধ্যার আগাম শাঁখের আওয়াজ, দুটো বাড়ি পরের ফ্ল্যাটের ছাদে দুটি শিশু রোজ দাপাদাপি করে খেলা করে, তাদের মায়েরা অলস আড্ডা মারে কিছুক্ষণ কাজের অবসরে। আমার বাবা-মায়ের ফ্ল্যাটটির পেছনে একটি জরাজীর্ণ তিনতলা বাড়ি আছে, তার একতলা ও তিনতলায় মানুষ বসবাস করে, দোতলাটি দেখলে মায়াই হয় – জানালার কাঠের ফ্রেম রোদে-জলে খুলে আলগা হয়ে ঝুলছে, প্লাস্টার করা নেই বাইরের দেওয়ালে, অযত্নের আগাছা শেকড়ের জন্ম দিয়েছে ইঁটের ফাঁকফোকর থেকে। শুধু তিনতলার রান্নাঘরের জানালাটি রোজ বিকেলে খোলা থাকে, ভেতরে মাইক্রোওয়েভ আভেন থেকে চিমনি সবই আছে, মনে হয় পরিবারটি গুছিয়ে সংসার করার চেষ্টা করছে। সেখানে রোজ ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে এক ভদ্রমহিলা চা বসিয়ে উদাস চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। সোজা সামনে তাকালে ওঁদের বাগান পাঁচিল ও আমাদের পরিসরটি পেরিয়ে আমার সঙ্গেই চোখাচোখি হয় ওঁর। আমি ছাদের এমাথা থেকে ওমাথা হাঁটার পথে ওঁদের দিকটায় পৌঁছলে দু সেকেন্ড থামি, উনি তাকান, হয়ত বোঝার চেষ্টা করেন যে আমি কে, আগে তো দেখেননি এই বাড়িতে। তারপর আবার আমি উল্টোদিকে হাঁটি, উনিও চায়ের কাপগুলি নিয়ে ভেতরে চলে যান। পাশের ফ্ল্যাটটির চারতলার ছাদে ওঠেন এক দম্পতি ও তাঁদের একটি শিশু। ভদ্রমহিলা নাকি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী আর ভদ্রলোক বোধহয় শিক্ষক। টুকটাক সাংসারিক আলোচনা সেরে নেন বিকেলের গুমোট বাতাসে। সব কথা হয়ত ঘরের ভেতর বলা যায় না, তাই ছাদে ওঠার সুযোগ হারাতে চান না। ওঁরা নিশ্চয়ই আমার মাকে চিনতেন, কারণ মা আগে প্রায় রোজই ছাদে উঠতেন। তাই হয়ত আমাকে দেখে অবাক হন, উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রাণীটিকে ঠিক ঠাহর করতে পারেন না। ওঁদেরই ফ্ল্যাটের তিনতলায় বাস করেন এক নব্বই ছুঁইছুঁই স্বাবলম্বী মাসিমা।  একা থাকেন, দুবেলা হোম ডেলিভারিতে খাবার আসে (প্রাক ও উত্তর-কোরোনা দুই কালেই), কাজের মাসি একজন আসে সকালে আর ওঁর প্রৌঢ় ছেলে আসেন রাত্রে শুতে। বেশ কয়েক বছর ধরেই মাসিমা একা থাকেন এই ফ্ল্যাটটিতে, একবার ফোনে কাউকে বলতে শুনেছিলাম যে ছেলে বা মেয়ের সংসারে থাকা ওঁর পোষায় না তাই একা থাকেন নির্ঝঞ্ঝাটে। মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন বলে ওঁর ছেলে রাত্রে পাহারা দিতে আসেন আজকাল। পরিপাটি করে গোছানো খাট বিছানা আমাদের পশ্চিমের জানালা খুললেই দেখা যায়। লিভিং রুমে একটা ডিভানে আলতো কাত হয়ে শুয়ে উনি টিভি দেখেন, কাগজ পড়েন, ফোনালাপ করেন, রেডিও শোনেন। আপাত দেখলে মনে হবে সেই মুন্নাভাই এমবিবিএসের মত, “খাওয়া নু, পিওয়া নু এ মজ্জানি লাইফ।” তবে অন্তরে অশান্তির অববাহিকা কি আর ফল্গুধারার মতে হলেও বয়ে যায় না?

এতগুলি টুকরো সাজিয়ে সাজিয়ে কোরোনা-জীবনের যেটুকু কাঁথা বুনতে শুরু করি, এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি গিয়ে পরের বার ফেরার সময়ে মনে হয় এই সবকটি টুকরোই আবার পাব তো? নাকি কোরোনার কাঁথা থেকে এক দুটি তারার মত খসে পড়বে আমার মায়ের মত। সেই জায়গাটুকু ভরাট করার সূতাটি আর নকশাটিও তারা সঙ্গে নিয়েই যায়, অগত্যা কাঁথাটি জীবনের মতই অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।

বিঃ দ্রঃ উপরোক্ত গল্পের শিশুটির ডাকনাম গদাই। শুনেই যারা নাক সিঁটকাবেন/জাজ করবেন, তাদের বলি, ওর একটা খটোমটো ভাল নামও আছে বাবা সন্দীপনের সঙ্গে মিলিয়ে, মনে পড়লে জানাব।

 
 

Tags: , ,

Leave a comment

 
The Ramblings of Don

Just my ramblings..... and sometimes my nostalgic memories!

Book Reviews by Satabdi

Candid opinions on books I read

photographias

photography and life

VR & G

Vigorous Radiant & Glowing

যযাতির ঝুলি | বাংলা ব্লগ | Jojatir Jhuli | Bangla Blog

বাংলা কবিতা, বাংলা গদ্য.. মুচমুচে, খাস্তা, অনবদ্য। ছুটির দুপুরে হোক না যোগ.. যযাতির গল্প, ছড়া, ব্লগ।।

feeble Lines

- By Adarsh

Natasha Ahmed

Author at Indireads

জীবনের আয়না

কিছু এলোমেলো ভাবনাচিন্তা

ব্লগম ব্লগম পায়রা

এটা-সেটা লেখা-দেখা...কখনো আনমনে কখনো সযতনে, টুকিটাকি আঁকিবুঁকি...সাদা-কালো সোজা বাঁকা

TRANSLATIONS: ARUNAVA SINHA

Bengali-to-English, English-to-Bengali literary translations

Cutting the Chai

India's original potpourri blog. Since 2005. By Soumyadip Choudhury

সাড়ে বত্রিশ ভাজা

একটি বাংলা ব্লগ

MySay.in | Political Cartoons and Social Views

Funny Cartoon Jokes on Latest News and Current Affairs.

Of Paneer, Pulao and Pune

Observations | Stories | Opinions

A Bookworm's Musing

Reading the world, one book at a time!

SpiceArt

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

Re.lexi.fication

Global structures. Local colour.

Abhishek's blog অভিষেকের ব্লগ

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

Calcutta Chromosome

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

Bookish Indulgences

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

monalisadesign

Monalisa's creations

of spices and pisces

food and the history behind it.