ফড়িং
ডিটেলঃ
ভাষাঃ বাংলা, রিলিজ তারিখঃ ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩, দৈর্ঘ্যঃ ২ ঘন্টা ০৭ মিনিট , ছবিঃ রঙীন, চিত্রনাট্য ও সংলাপঃ ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী ও সুগত সিনহা, সঙ্গীতঃ প্রবুদ্ধ ব্যানার্জী, পরিচালনাঃ ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী
অভিনয়েঃ সোহিনী সরকার, আকাশ অধিকারী, সৌরভ বসাক, ঋত্বিক চক্রবর্তী, দ্বিজেন বন্দোপাধ্যায়
সমালোচনাঃ
‘ফড়িং’ ছবিটি নিয়ে এত আলোচনা এবং বিতর্ক হয়েছে, অথচ ইন্টারনেটে কোনো বাংলা ব্লগে এখনো ছবিটির নিয়ে কিছু লেখা নেই। বাংলা ব্লগাররা কি ছবিটিকে ব্রাত্য করেছেন বিতর্কের জন্যে? আমার মত আরো অনেকে নিশ্চয়ই সপ্তাদুয়েক আগে টিভিতে ছবিটি দেখে ফেলেছেন। গ্রীষ্মের গনগনে দুপুরে ঘুরন্ত ফ্যানের হাওয়ার নীচে শুয়েবসে তিনটি ঘন্টা ‘ফড়িং’ দেখে দিব্যি কেটে গেল। না, ছবিটি মাত্র দু’ঘন্টারই, তবে টিভিতে দেখবেন আর বিজ্ঞাপনের মাসুল দেবেন না, তা কি হয়! কাগজে পড়ে জেনেছিলাম ছবিতে আলোচ্য দুটি বিষয় – নবাগতা সোহিনী সরকার ও বয়ঃসন্ধির যৌনতা। তার সঙ্গে যোগ করব অসাধারণ চিত্রগ্রহণ, দারুণ কিছু সংলাপ আর কিশোর অভিনেতা আকাশ অধিকারী।
আকাশ ওরফে ফড়িং থাকে উত্তরবঙ্গে, পড়ে ইশকুলে, মদ্যপ বাবার কাছে মার খায় আর তার মায়ের একটাই হুঙ্কার ঘন ঘন শোনে, “আমি কিন্তু বর্ডার পার করা মাইয়াছেলে।” ফড়িংয়ের খুব কাছের বন্ধু ভগবান। সে মনে মনে যা প্রশ্ন করে, তার মাথার ভেতর ভগবান সব উত্তর সাজিয়ে দেন এক এক করে। প্রথম কয়েকটি সিনে শস্য শ্যামলা উত্তরবঙ্গ দেখে চোখ ভরে গেলে সংলাপে মন দেবেন। চায়ের দোকানে প্রৌঢ়দের আড্ডায় নিমাই ঘোষ দুর্দান্ত। এত ছোট ভুমিকাতেও কী করে ফাটিয়ে দেন সেটাই দেখার মত। ফড়িংয়ের জীবন দিব্যি চলছিল মারধোর-বন্ধুবান্ধব-বয়ঃসন্ধির দুষ্টুমি-নিষিদ্ধ ছবি-ক্লাসে ফেল করা নিয়ে। তার মধ্যে হঠাৎ এলেন ইতিহাসের শিক্ষিকা দোয়েল মিত্র।
অন্য ম্যাডামদের মত মধ্যবয়স্কা, খিটখিটে, উল বোনা-পিএনপিসি টাইপ নন; অল্পবয়স্কা, সুন্দরী, সুভাষিণী এবং কলকাতা নিবাসী। মফস্বলের ইশকুলে কলকাতার ম্যাডাম এলে সাধারণত যে চাঞ্চল্য পড়ে যায় সহশিক্ষক এবং ছাত্রদের মধ্যে, সেটাকে যথার্থভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক। ম্যাডামের বাড়ি কাজের লোক আছে কিনা, বা ম্যাডামের জ্যেঠতুতো দাদা আসলে ওঁর বয়ফ্রেন্ড কিনা, এইসব জল্পনা অবধারিত। পরীক্ষার খাতায় ফড়িংয়ের কল্পনাশক্তি দেখে ম্যাডাম ওকে বাড়িতে পড়তে ডাকেন, আর তাতে ফড়িংয়ের জীবনে একটা নতুন দিগন্ত খুলে যায়। বিদেশী খাবার প্যানকেক থেকে জন্মদিন পালন, মোবাইল ফোনে ছবি তোলা থেকে জার্নাল লেখা – সব কিছুই নতুন করে ফড়িং।
যৌনতা নয়, ছবিটি দেখে আমার মনে হয়েছে ম্যাডাম আর ফড়িংয়ের অসমবয়সী বন্ধুত্বটা বেশি ইন্টারেস্টিং। বয়সন্ধির প্রথম ভাললাগা, একটু ঘনিষ্ঠতা, জ্যেঠতুতো দাদাকে দেখে ফড়িংয়ের হিংসে, এসবই স্বাভাবিক, কিন্তু এর আগে বাংলা ছবিতে কেউ দেখাননি। হয়ত কিশোররা ‘নষ্ট’ হয়ে যাবে সেটা ভেবেই এতকাল মর্যালি কারেক্ট ছবি বানানো হয়েছে। কিন্তু আজকের কিশোররা কী ভাষায় কথা বলে, কী ভাষায় ভাবে, সেটা যাঁরা জেনেও না জানার ভান করেন, ফড়িং দেখে অন্ততঃ তাঁদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। এর আগে বাংলা ছবিতে ১৩-১৪ বছরের কিশোরের ভূমিকা থাকত নায়িকার ভাই হিসেবে, একটু ক্যাবলা, অথবা অনাথ আর অসহায়। আর আজকে তারা অবলীলায় সহপাঠীকে বলে, “মা ক্যালাবে বলে ভয় পাচ্ছিস কেন? একটু সহ্য করে নিবি।” নাম ভূমিকায় আকাশ অধিকারীকে দিয়ে খুব ভাল অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন পরিচালক। সেইসঙ্গে কিছু দারুণ চিত্রগ্রহণে আকাশের বডি ল্যাঙ্গোয়েজে ফুটে ওঠা বয়ঃসন্ধিকে তুলে ধরেছেন।
ছবির প্রথম ভাগ অসাধারণ, কিছু বলার নেই। গ্রামের গাছঘোরা নাচগান বা শহুরে পার্টির থেকে একেবারে ভিন্ন বাংলার মফস্বল দেখবেন, যেসব জায়গায় হয়ত আমি বা আপনিও ছোটবেলা কাটিয়েছি। দ্বিতীয় ভাগ ছবিটিকে অনেকটাই ঘেঁটে দিয়েছে, এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। গল্পটাকে জটিল করতে গিয়ে কোথাও একটু ছানা কেটে গেছে। প্রথম ভাগের সারল্যের সাথে দ্বিতীয় ভাগের প্লটের অমিল স্পষ্ট। শেষ অব্দি দেখার আগ্রহটা একটু হারিয়ে যায়, আর উপসংহারে কী হবে সেটা বেশ বোঝা যায়। তবে তাতে কী? এটা তো আর গোয়েন্দা গল্প নয়। তবে দ্বিতীয় ভাগের জন্যে বেশি নম্বর দিতে পারলাম না।
অভিনয়ে সবাই যথাযথ। সোহিনী সরকার ইদানিংকালে চমৎকার অভিনয় করেছেন। ছোট ভূমিকাতে ঋত্বিক চক্রবর্তীও দিব্যি, ফড়িংয়ের বন্ধু লাট্টুকেও দেখার মত। আর ফড়িং? ছবির শেষে একটি সংলাপে সে বাজিমাত করে দিয়েছে – “দেখো ভগবান, যা বোঝো না তা নিয়ে বেশি কথা বলতে এসো না।”
আমি কত দিলামঃ ৩.৭৫/৫ (পাঁচে পৌনে চার)
IMDb কত দিলঃ 8.1/10