RSS

বানভাসি

পরীক্ষা দিয়ে ল্যাব থেকে বেরিয়েই নীল অবাক হয়ে গেল। ভাবতেই পারেনি যে এরকম একটা চমক অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে। ডিপার্টমেন্টের সামনের উঠোনটায় দাঁড়িয়ে দেখল অসময়ে রাত্রি নেমে এসেছে। ছ’ঘন্টা প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা দেওয়ার পর এখন বিকেল সাড়ে চারটে, অথচ আকাশ ঠিক রাতের মত গাঢ়। ল্যাবের ভেতরে বসে বুঝতে পারছিল যে মেঘ করেছে, অন্ধকার নেমে আসছে, কিন্তু সেটা যে এতটা তা বোঝেনি। কুড়ি বছরের জীবনে এরকম ও আগে কখনো দেখেনি। একটা ক্যামেরা যদি এখন থাকত এই মুহুর্তটা ধরে রাখতে পারত। ভাবতে ভাবতেই, “কী রে, দেখেছিস কীরকম বৃষ্টি আসছে? আজ আর কেপিসি-র বাড়ি পড়তে যাওয়া হবে না,” সপ্তর্ষি এসে ডাক দিল।
নীল বলল, “বাঁচা গেল। এইরকম ওয়েদারে বসে স্টিরিওকেমিস্ট্রি পড়া পাপ হবে। চ’ ক্যান্টিনে যাই।”
বৃষ্টির ভয়ে প্রায় সবাই বাড়ির জন্যে রওনা দিয়েছে, তাই ওরা ক্যান্টিনে গিয়ে মাত্র দু’চারজনকেই পেল। আর বসেছিল মীরা, নীলের বান্ধবী। ওরা রোজই বাড়ি যাওয়ার আগে ক্যান্টিনে কিছুক্ষণ বসে, আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
চা খেতে খেতে সপ্তর্ষি বলল, “এবার আমাদেরও কেটে পড়া উচিত। দেখ এখনই ঝমঝম করে নেমেছে।”
“এই সেপ্টেম্বরে অসময়ে এত বৃষ্টি কেন হচ্ছে বল তো?” মীরা জিজ্ঞ্যেস করল।
“পুজোর আগে অব্দি টেকনিক্যালি বর্ষাকাল ধরে নে,” সপ্তর্ষি বলল।
নীল উত্তর দিল, “নিম্নচাপ-টাপ হবে নিশ্চয়ই। পুজোর কটা দিন না ডোবায় মাইরি। এই তো এসেই গেল প্রায়।”
বইখাতা ল্যাবের লকারে রেখে কাকভেজা ভিজতে হবে ধরে নিয়েই ওরা বেরিয়ে পড়ল। তিনজন বলা যায় প্রায় তিন দিকে যাবে। বৃষ্টির দেওয়াল ভেদ করে বাসের হেডলাইটগুলোকে দৈত্যাকার ষাঁড়ের মত এগিয়ে আসতে দেখে নীলের বেশ মজা লাগছিল। বহুদিন পরে ভেজার এরকম সুযোগ পেল ও। বাসস্ট্যান্ডে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়াতে গিয়ে একটা দমকা হাওয়ায় মীরার ছাতা এবং সঙ্গে সেও প্রায় উড়ে যাচ্ছিল। ওর ঢাউস ব্যাগের ভেতর যে কী থাকে কেউ জানে না, তাই অসময়ের বর্ষায় সেখান থেকে ছাতাও বেরোয়। বড্ড রোগা মেয়েটা, ভাবল নীল। গভীর চিন্তায় আরো রোগা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ওর সাথে এটা নিয়ে কথা বলতে হবে শিগগিরই। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পরে মীরা সরু গলায় “এই আমার বাস, আমার বাস,” বলতে বলতে দৌড়ে কোনোরকমে বাসে উঠে পড়ল।
ঠান্ডা জলে ভিজে হঠাৎ একটা কাঁপুনি দিয়ে সপ্তর্ষি বলল, “আমি আর ডিরেক্ট বাসগুলো পাব না মনে হচ্ছে বুঝলি। এমনিতেই কম থাকে, আর আজকে তো কতক্ষণ পরে একেকটা আসছে।”
“তাহলে তুই এক কাজ কর, আমার সাথে পার্ক সার্কাস অব্দি চল। ওখান থেকে বাস পালটে নিস।”
“তাই করি। এর পরে যেটা আসবে ওই দিকের, উঠে পড়ব।”
দেড় ঘন্টা পরে আপাদমস্তক ভিজে ভীড় বাসে দরজার কাছে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে কন্ডাক্টরের মাথার ওপর দিয়ে নীল দেখল রাস্তায় এক হাঁটু জল জমে গেছে। বড় রাস্তায় হাঁটুজল মানে তাদের বালিগঞ্জ প্লেস নিশ্চয়ই ভাসছে এখন! এহ হে, মা বোধহয় খুব চিন্তা করছে। কলেজের বাইরের বুথ থেকে ফোন করে দেওয়া উচিত ছিল বেরোবার সময়ে। বাসটা প্রায় মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে আছে দেখে যাত্রীরা বিরক্ত হয়ে কন্ডাক্টরকে প্রশ্ন করতে উত্তর এল, “সামনে হেব্বি জ্যাম দাদা, কিচ্ছু করার নেই। গড়িয়াহাট পুরো ডুবে গেছে।”
ঠেলে-গুঁতিয়ে, কারুর কনুইয়ের ধাক্কা, কারুর ব্যাগের বাড়ি খেয়ে নীল অনেক কষ্টে জলের মধ্যে ছপাৎ করে নামল। শর্টকাট দিয়ে আস্তে আস্তে জল ভেঙে পাঁচ মিনিটের রাস্তা প্রায় মিনিট পনেরোয় হেঁটে ও যখন বাড়ির সামনে পৌঁছল, দেখল বারান্দায় গ্রিল ধরে মা চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে।
“কী রে…”
“দাঁড়াও দাঁড়াও, জানি তুমি কী বলবে। ফোন করার কথা একদম ভুলে গেছিলাম, সরি!”
“আর কী হবে, এতবার বাজ পড়ে ফোন এমনিতেই ডেড হয়ে গেছে। কিন্তু তুই তো ভিজে জাব হয়ে গেছিস একেবারে।”
“এত বৃষ্টিতে আর কী আশা করো? ওয়ান পিসে বাড়ি ফিরলাম সেটাই কি অনেক নয়?”
“বাজে কথা রাখ তো! যা, শিগগির একটু চান করে নে, গরম জল করে দিচ্ছি। রাজ্যের নোংরা মাড়িয়ে এলি রাস্তায়।”
“বাথরুমে জল ঢুকেছে নাকি?”
“বাইরেরটায় ঢুকেছে। ভেতরের ঘরেরটায় যা।”
এই এক সমস্যা ওদের ভাড়া বাড়িতে। জায়গাটা বালিগঞ্জ প্লেস হলে কী হবে, অত্যান্ত নীচু। একটু বেশী বৃষ্টি হলেই এক ধাপ নীচে ইন্ডিয়ান স্টাইল বাথরুমটায় জল ঢুকে যায়। ভেতরে আরেকটা বাথরুম আছে তাই রক্ষে।
স্নান সেরে ওর প্রিয় আদা-চা খেতে খেতে নীল জিজ্ঞ্যেস করল, “বাবা কি ফোন ডেড হওয়ার আগে কল করেছিল নাকি? ট্রেনলাইনে জল জমে গেলে তো ফিরতে অনেক রাত হবে।”
“নাহ, তিনিও তো আরেকজন। কতবার বলেছি দুর্যোগ বুঝলে একটা ফোন করতে যে কখন বেরোচ্ছে। তা কে কার কথা শোনে!”
“যাকগে, আজকে তো কী অবস্থা বুঝতেই পারছ। কলেজ স্ট্রীট থেকে ফিরতে আমারই দু’ঘন্টা লাগল। কাজেই বাবা যদি শিয়ালদায় নেমে বাসও ধরে, আরও দেরী হবে।”
“কী জানি বাপু, আমি খালি চিন্তা করেই মরি। একটাই ফোন, সেটাও না চললে কারুর কোনো খবরই পাব না।”
মা আবার উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল বাবার প্রতীক্ষায়। বাইরে নিরন্তর বৃষ্টি হয়েই চলেছে, শুধু বেগটা একটু কমেছে। আজ পরীক্ষা শেষ, তায় সামনে পুজো। পড়াশোনার পাট আপাতত চুকোনো। ফোন খারাপ হওয়াতে মীরার সাথেও কথা বলা যাবে না এখন। অগত্যা একটা গল্পের বই নিয়ে আরাম করে বসল নীল, তবু মাঝে মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছে বারান্দায়। অবশেষে বাবা বাড়ি ফিরল রাত দশটা নাগাদ। ও যা ভেবেছিল তাই, শিয়ালদা অব্দি কোনোরকমে ট্রেনে আসলেও সাউথ সেকশনটা পুরো জলের তলায় হওয়াতে বাকীটা বাসে করে আসতে হয়েছে।
খিচুড়ি-ডিমভাজা দিয়ে জমিয়ে ডিনার করে কতক্ষণ যে অঘোরে ঘুমিয়েছে তা টেরই পায়নি নীল। সকালে ঘুম ভাঙল মায়ের উদ্বিগ্ন ডাকে।
“শিগগির ওঠ, সাঙ্ঘাতিক কান্ড হয়েছে।”
ধড়মড় করে উঠে ও দেখল ঘরের ভেতর কুলকুল করে জল ঢুকছে। খাটের ওপর বসে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ ঘুমচোখে। মায়ের কথায় যা বুঝল, সারারাত তুমুল বৃষ্টি হওয়ার ফলে সারা শহরেই জল থইথই। বাবা অফিস যেতে পারেনি, ট্রেন-বাস সব বন্ধ। এখনও বৃষ্টি হয়েই চলেছে, থামার কোনো নাম নেই।
মা বলল, “শোন, দুই বাথরুমেই জল ঢুকে আছে। তুই ওপরের বাড়িওয়ালা কাকিমাদের বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে নে।”
ওপরে গিয়ে নীল দেখল বাবা বসে বাড়িওয়ালা নির্মল-কাকুর সাথে আলোচনা করছে যে কী করা যায়। মুখ ধুয়ে কাকিমার থেকে চা নিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসল ও।
কাকু বললেন, “আপনারা খাট আর আলমারির ওপর জিনিসপত্র যা পারেন তুলে রেখে এখানে এসে থাকুন যতক্ষণ না জল নামে।”
প্রস্তাবটা শুনে একটু অবাক হলেও এই মুহুর্তে আর কোনো উপায় নেই ওদের কাছে। জলের মধ্যে অনির্দিষ্টকাল বসে থাকা তো আর যায় না, অগত্যা বাড়িওয়ালারাই ভরসা।
চা-পাঁউরুটি খেয়ে নীল কাজে লেগে পড়ল বাবা-মার সাথে। সবার আগে ওর পড়ার বইগুলো দেওয়ালের তাকে তুলে দিল। গল্পের বইয়ের আলমারিটা ভাগ্যিস এমনিতেই উঁচু। অতগুলো বই সরাতে গেলে তো সারাদিন লেগে যেত! তিনজনে ধরাধরি করে বিছানা-বালিশ সব আলমারির ওপর চাপিয়ে দিল। খাটটাকে ন্যাড়া দেখে নীলের দুঃখ হচ্ছিল বেশ। এটা নাকি ওর জন্মের পর বানানো হয়েছিল। এত বছর সার্ভিস দিয়ে এবারে না জলে দেহ রাখে।
জরুরি জিনিসগুলো সরাতেই প্রায় দুপুর হয়ে গেল। ফোনটা না চলাতে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব কারুরই কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। মীরার জন্যে চিন্তাটা একঝলক করে মনে এসেই আবার উবে যাচ্ছে কাজের ঠেলায়।
“উফ, অবশেষে সব হল। আর পারি না রে এই বয়সে,” বাবা প্রায় কাতরাতে কাতরাতে বলল। এই কিছুক্ষণ আগে ওরা সব কাজ শেষে স্নান-খাওয়া সেরে একটু বসেছে, আর এর মধ্যেই বিকেল হয়ে গেল। বাড়িওয়ালারা তিনতলায় একটা ঘর ওদের থাকার জন্যে ছেড়ে দিয়েছেন।
তিনতলার বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছিল নীল। যতই ঘ্যানঘ্যানে হোক, বৃষ্টির একটা আলাদা মায়া আছে। অবশ্য শুকনো ঘরে আরামে বসে বৃষ্টি দেখতে যতটা না ভাল লাগে, এখন একঘর জলের মধ্যে বসে থাকলে নিশ্চয়ই ভাল লাগত না।
মীরাটা কী করছে একা একা? ওর বাবা-মার ডিভোর্স কেস চলছে এখন। সেইজন্যে মেয়েটা খুব বিমর্ষ থাকে সবসময়ে। না চাওয়া সত্ত্বেও ওকে এখন বাবা-মাকে ভাগ করে দিতে হবে। অনেক বছর ধরেই ও দেখছে বাবা-মার ঝগড়া কে আস্তে আস্তে তিক্ততায় পৌঁছে যেতে। তবে সে সব নিয়েও অন্তত তিনজনে এক ছাদের তলায় ছিল, এক পরিবার হয়ে। মীরা বোঝে যে দুজন মানুষের মধ্যে তিক্ততা এই পর্যায়ে চলে গেলে তাদের একসাথে না থাকাই বাঞ্ছনীয়, অথচ মেয়ে হিসেবে ওর মন দুজনকেই ধরে রাখতে চায়। তাই হয়ত ও আরো বেশী করে নীলকে আঁকড়ে ধরে। মাঝে কদিন খুবই ডিপ্রেশনে ভুগছিল মীরা। কলেজে আসত না, ট্যুইশনেও না। নীল ওর বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওকে আবার ফিরিয়ে আনে। সপ্তর্ষি আর ও মিলে মীরার জন্যে সব নোটস কপি করে রেখেছিল যাতে ওর কোনো অসুবিধা না হয়। এই দায়িত্বগুলোর জন্যেই দুদিন মেয়েটার খোঁজ না পেলে ওর খুব চিন্তা হয়। সপ্তর্ষিরও কোনো খবর পাওয়ার উপায় নেই।
কী করা যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ওর চোখে পড়ল কে যেন জল ভেঙে ওদের বাড়িতে ঢুকছে। এত জল বলে এমনিতেই রাস্তায় লোক খুব কম। শুধু মাঝে মাঝে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের লোকেদের চাল-ডাল-চিঁড়ে নিয়ে বেরোতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই লোকটি তো তাদের কেউ নয়। একে নীল খুব ভাল করেই চেনে যে! এ হল ওর ছোটকাকা, যাকে ও কুট্টি বলে ডাকে। বিস্ময়টা কাটিয়ে ওঠার আগেই দোতলার দরজায় কড়া নাড়ল কুট্টি। নির্মলকাকু বছরখানেক আগে অব্দিও ওকে এবাড়িতে নিয়মিত আসতে দেখেছেন, তাই কোনো দ্বিধা না করে ওকে ঘরে এনে বসালেন।
নীল অবাক হয়ে বলল, “কুট্টি, তুমি হঠাৎ…”
“তোদের কী অবস্থা দেখতে এলাম।”
“এই তো দেখছ। সব মালপত্র আলমারির ওপর তুলে এখানে এসে রয়েছি।”
“দাদা-বৌদি কোথায়?”
বলতে বলতেই বাবা-মা এঘরে এল। কে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে সেই নিয়ে নীলের আশঙ্কা থাকলেও বাবা খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “তোর ওখানে কী অবস্থা?”
“কাল সন্ধ্যে থেকেই গ্যারেজের অফিসঘরে জল ঢুকছিল। অনেক রাত অব্দি আমি আর বাপি মিলে জিনিসগুলো ঘরে তুললাম। আজ সকালেই আসব ঠিক করেছিলাম তোমাদের সাহায্য করতে। কিন্তু বাপির পায়ে জলের মধ্যে কোথা থেকে একটা পেরেক ফুটেছে। তাই ওকে নিয়ে ডাক্তার-ইঞ্জেকশন করছিলাম।”
নীল সব শুনছিল আর ভাবছিল, যাক এবারের মত গোলমালটা কাটতে পারে বোধহয়।
গত এক বছর ধরে কুট্টির সঙ্গে ওদের যোগাযোগ বন্ধ ছিল। বাবাই বন্ধ করেছিল। কুট্টি পড়াশোনা বেশীদূর করেনি, অনেক স্ট্রাগল করে এখন নিজের ব্যবসা চালায়। বিভিন্ন অফিসে যেসব ফার্নিচার ব্যবহার করা হয় – টেবিল, চেয়ার, ল্যাম্প, অন্যান্য ডেকোরেশান – তার সাপ্লাই। কিছু ফ্রিল্যান্স ইন্টিরিয়ার ডেকরেটার আছে, তারা ডিজাইন দিলে সেইমত কুট্টি কারিগর দিয়ে জিনিসগুলো বানিয়ে সাপ্লাই দেয়। বছর সাত-আট ধরে বেশ ভালই চলছে। নীলের এটা ভেবে দিব্যি লাগে যে শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় কুট্টি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। ছোটবেলা থেকেই ও দেখে আসছে কুট্টি এদিকে-ওদিকে নানা বন্ধুর ঘরে কোনোমতে থাকত, কাজ যোগাড় করতে বেরোত, আবার তার মধ্যেই পয়সা বাঁচিয়ে ওকে জন্মদিনে বই, চকোলেট, ক্রিকেট ব্যাট দিত। ওর ভাল নামটাও নাকি কুট্টিরই দেওয়া, স্বপ্ননীল। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্রিকেট পেটানো, হোমওয়ার্ক আর কমিক্সের থেকে ও ফুরসতই পায়নি এটা নিয়ে ভাবার। আরেকটু বড় হওয়াতে স্কুলের বন্ধুরা জিজ্ঞ্যেস করাতে ওর খেয়াল হল স্বপ্ননীল কেন, স্বপ্নের আবার রঙ হয় নাকি? তখন জানতে পারল কুট্টি নাকি কোন উপন্যাসে পড়ে নামটা খুব পছন্দ হওয়াতে একমাত্র ভাইপোকে সেটা উপহার দিয়েছিল।
এখন কুট্টি ওদের দুটো পাড়া পরেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। গ্যারেজে অফিস করেছে, কয়েকজন কর্মচারী রেখেছে। নীল মাঝে মাঝে গিয়ে ওখানে আড্ডা মেরে আসে। এক-দেড় বছর আগে কুট্টি প্রস্তাব দেয় যে রিটায়ার করে বাবা ওর ব্যবসায় ঢুকলে ভাল হয়। বাবা কয়েকদিন যাতায়াতও করেছিল ওর অফিসে, কাজটা সম্পর্কে আরো জানতে। তারপর হঠাৎ একদিন এসে বলল, “ও ব্যবসায় আমি যাব না।” এর বেশী আর কিছু বলতেই রাজী হচ্ছিল না কেন কে জানে। মুখের ওপর ‘না’ শুনে কুট্টি প্রচন্ড অবাক হয়ে গেছিল। একমাত্র বড় দাদার কাছ থেকে এরকম বিরাগ ও কখনই আশা করেনি। বাবাকে মা অনেক খোঁচানোর পর শুধু এইটুকু বলল, “ও জোচ্চুরি করছে। আমি ওখানে ঢুকতে পারব না।” এই অভিযোগ কুট্টি নাকচ করার পরেও বাবা মত পাল্টায়নি। বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলেছিল বোধহয়। সেই টানাপোড়েনের পর থেকে বাবাও আর যায় না, কুট্টিও আসে না। নীল যাবে কি যাবে না তাই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থাকে সবসময়। ছোটবেলা থেকে একই আদর্শ শেখা সত্ত্বেও ওর নিজেকে বেশ দুর্বল মনে হয়। বাবার জায়গায় ও থাকলে এতটা করতে পারত না কিছুতেই। যে কুট্টিকে ওরা সবাই এত ভালবাসে, তার সাথে এতদিন যোগাযোগ না রাখাটা ওর ঠিক মনে হয় না। কেন, তা ও নিজেও জানে না। এটা কী নিছক দুর্বলতা, নাকি কাপুরুষতা, এই প্রশ্নটা মাঝে মাঝেই ওর মনে ভেসে উঠে।
ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে ও শুনল মা কুট্টিকে জিজ্ঞ্যেস করছে, “কাল থেকে খাওয়া-দাওয়া করেছ কিছু?”
“হ্যাঁ, আমারও বাড়িওয়ালা মাসিমাই খাওয়াচ্ছেন। রান্নাঘরে অব্দি জল ঢুকেছে এবার।”
“কদিন এরকম চলবে কে জানে! জল নামলে সব পরিষ্কার করতে জীবন বেরিয়ে যাবে আমাদের।”
“আমি আর বাপি এসে হাত লাগাব, চিন্তা কোরো না।”
এই কথাটা শুনে বাবা একবার কুট্টির দিকে তাকালেও মুখে কিছু বলল না। নীল বোঝার চেষ্টা করছিল যে বাবা এখন কী ভাবছে। একদিকে কুট্টির ওপর রাগ-অভিমান থাকলেও বাবা খুশি যে এই দুর্যোগে আপনজনদের মধ্যে একমাত্র কুট্টিই এসেছে সাহায্য করতে। ও মনে মনে চাইছিল এবার যেন ঝামেলাটা মিটমাট হয়ে যায়। বাবা যেন আগের কথা ভুলে কুট্টিকে আবার কাছে টেনে নেয়। বাড়িওয়ালার সামনে কুট্টি সোজাসুজি বাবাকে কিছু না বললেও ওর মুখ থেকে মনে হয় ও এখন ক্ষমা চাইতে রাজী। কাল সকালে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও চলে গেলে নীল একটু হালকা মনে ঘুমোতে গেল। এই কঠিন পরিস্থিতিরও যে একটা পজিটিভ দিক থাকতে পারে তা গতকাল অব্দি কেউ ভাবতেও পারেনি।
খুব সকালে পাখির কিচিরমিচিরে ওর ঘুম ভাঙল। প্রথমে ভাবল, বোধহয় স্বপ্ন দেখছে। বারান্দায় এসে দেখল বৃষ্টিধোয়া এক অপূর্ব ভোর ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ। বালিগঞ্জ স্টেশনের ওপর একফালি আকাশে সূর্য্যটা টুপ করে উঠে পড়তে নীলের তন্ময়তা কাটল। বাইরে তাকিয়ে দেখল রাস্তার জল নেমে গেছে, আকাশ পরিষ্কার। একটু পঙ্কিল হলেও সকালটা খুব সুন্দর। কী মনে হতে বাইরের ঘরে এসে ফোনটা তুলতেই ডায়াল টোনের একঘেয়ে আওয়াজটাও ওর প্রিয় মনে হল। ও ঠিক করল আজ থেকে জীবনটাকে নতুন করে শুরু করবে, আর তার সূচনা হোক মীরাকে ওর মনের কথা জানিয়ে।
[এই গল্পটি ২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯-এর বন্যায় আক্রান্ত সমস্ত কলকাতাবাসীর জন্যে লেখা]

*এই গল্পটি eবংonline.com-এর মার্চ ২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত *

 

Leave a comment

 
The Ramblings of Don

Just my ramblings..... and sometimes my nostalgic memories!

Book Reviews by Satabdi

Candid opinions on books I read

photographias

photography and life

VR & G

Vigorous Radiant & Glowing

যযাতির ঝুলি | বাংলা ব্লগ | Jojatir Jhuli | Bangla Blog

বাংলা কবিতা, বাংলা গদ্য.. মুচমুচে, খাস্তা, অনবদ্য। ছুটির দুপুরে হোক না যোগ.. যযাতির গল্প, ছড়া, ব্লগ।।

feeble Lines

- By Adarsh

Natasha Ahmed

Author at Indireads

জীবনের আয়না

কিছু এলোমেলো ভাবনাচিন্তা

ব্লগম ব্লগম পায়রা

এটা-সেটা লেখা-দেখা...কখনো আনমনে কখনো সযতনে, টুকিটাকি আঁকিবুঁকি...সাদা-কালো সোজা বাঁকা

TRANSLATIONS: ARUNAVA SINHA

Bengali-to-English, English-to-Bengali literary translations

Cutting the Chai

India's original potpourri blog. Since 2005. By Soumyadip Choudhury

সাড়ে বত্রিশ ভাজা

একটি বাংলা ব্লগ

MySay.in | Political Cartoons and Social Views

Funny Cartoon Jokes on Latest News and Current Affairs.

Of Paneer, Pulao and Pune

Observations | Stories | Opinions

A Bookworm's Musing

Reading the world, one book at a time!

SpiceArt

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

Re.lexi.fication

Global structures. Local colour.

Abhishek's blog অভিষেকের ব্লগ

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

Calcutta Chromosome

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

Bookish Indulgences

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

monalisadesign

Monalisa's creations

of spices and pisces

food and the history behind it.