RSS

কলকাতা কচকচিঃ ৪ – ছুটিতে খাওয়া দাওয়া

28 Dec
কলকাতা কচকচিঃ ৪ – ছুটিতে খাওয়া দাওয়া

কিছুদিনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে গেছিলাম। ওই যা হয় আর কী, বাবা মায়েদের বয়েস হলে বছর বছর মেডিকাল ও অন্যান্য কারণে ট্রিপ হয়ে যায়। সেই হাসপাতাল-বাড়ি-ট্যাক্সি-মেট্রো-ব্যাঙ্ক-সরকারি অপিস ইত্যাদির গোলকধাঁধার মধ্যে খুঁজে ও খুঁটে বেশ কিছু জিনিস খাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাদের মোটামুটি একটা লিস্ট করা থাকে খাবারের যার কিছু দোকানে, বাকি বাড়িতে যোগাড় ও রান্না করে খেলে ভাল হয়। এমন সব জিনিস যা ধরুন ব্রাসেলসে পাওয়া যায় না অথবা পেলেও মান খুবই ইয়ে টাইপের। কিছু জিনিস বাবা মায়েরাই খুঁজেপেতে আনালেন, কিছু আত্মীয় বন্ধুরা যোগাড় করে দিলেন আর কিছু আমরাই ঘুরে ঘুরে খেলাম। এর মধ্যে কয়েকটি পোষালো, কয়েকটি নয়, কয়েকটি ব্যাপক লাগল, কয়েকটি মোটামুটি।

১। ঘাসপাতা দিয়েই শুরু করি। বেটার হাফের একটা দাবী থাকে পঃবঃ গেলেই, তার খেসারির শাক চাই। পরিবারের সবাই জানে এবং শীতের আশেপাশে পৌঁছলেই খোঁজার চেষ্টা করে। এবারে ডিসেম্বর শুরুতে ছিলাম বলে বেটার হাফের মাসি এলাকার বাজারে বলেকয়ে খেসারি যোগাড় করে, রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমার এমন কিছু উথালিপাতালি নেই খেসারি নিয়ে, নিজস্ব স্বাদ নেই খুব একটা, ঠেসে কাঁচালঙ্কা দিয়ে ভাজলে খেতে ভাল লাগে অবশ্য। এক সময়ে খেসারির ডাল ব্যানড ছিল, কিন্তু এখন নয় এবং শাকটি শুনেছি খুবই উপকারী। কলকাতায় কজন খেসারি খেয়েছেন জানি না তবে আমাদের মফস্বলে শীতকালে দিব্য পাওয়া যায়। 

২। নভেম্বর মাসে কলকাতা ও মফঃতে শীতের বংশও ছিল না, তবু সেই বিরল সব্জিরা দেখা দিয়েছে যার জন্য আমরা হাঁ করে বসে থাকি – সজনে ফুল (ও ডাঁটা) আর বকফুল। অসময়ের সজনে ফুল বলে কিনা জানি না, দামও বেশ আর খেতেও সেরকম জুতের ছিল না। বকফুলগুলি কচি হলেও আমাদের রান্নার দিদি আনন্দ করে বেসনের ব্যাটার বেশি ঘন করে ফেলেছিলেন। খুব একটা স্বাদ পাইনি এগুলিতে। তবে ডাঁটা বেশ কচি ও জব্বর ছিল, ডাঁটাপোস্ত বলে দারুণ ব্যাপারটা দিদি ভালই বানিয়েছিলেন। 

৩। পেঁয়াজকলিও বোধহয় আজকাল বছরের অনেক সময়েই পাওয়া যায়। আমরা যেগুলি পেয়েছি তা অবশ্য কচি নয়, বরং একটু কচকচেই ছিল। তবু শিম, বেগুন আর ট্যাংরা মাছ দিয়ে আমি অন্তত ভালবেসে খেয়েছি। ব্রাসেলসে পেঁয়াজকলি, শিম, বেগুন পেলেও ডিমভরা ট্যাংরা যেন দিবাস্বপ্ন। তাই আমি গেলেই সবাই খোঁজে ট্যাংরা আর কাতল খাওয়াবে বলে। 

৪। কাতলেরও কয়েকরকম টাইপ পেলাম। বেশ কিছু বুঝলাম চাষ করা, ওষুধ দিয়ে বাড়ানো কারণ ওই ওষুধের গন্ধটা আমার ভীষণ নাকে লাগে। একদিন বাড়িতে সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া হল (জনা ১৮-১৯ মত), সেদিন বাজার থেকে বেটার হাফ বেশ ভাল কাতল পেয়েছিল। রান্নার দিদিও জম্পেশ করে কালিয়া করেছিলেন। পরের দিন ওই মাথা দিয়ে একটা ব্যাপক ঝাল করেছিলেন। এটা আগে কোথাও খাইনি, শুধু মাছের মাথার ঝাল, বেটার হাফের মায়ের রেসিপি। বাকি হাফ মাথা দিয়ে বাঁধাকপির চচ্চড়িও খারাপ ছিল না। ওদিকে আমার বাবা বানিয়েছিলেন চিংড়ি দিয়ে বাঁধাকপি, সেটা বরঞ্চ খাসা হয়েছিল। 

৫। গঙ্গার ধারে বাড়ি বলে বেশ কিছু ছোট ব্যবসায়ী আড়ত থেকে বা গঙ্গার ধারের নিলাম থেকে অল্প মাছ তুলে বাড়ির পেছনের রাস্তায় বিক্রি করেন। সেখানে পেলাম বেশ তাজা মাঝারি সাইজের বাটা মাছ। লোকে কাঁটা বলে হ্যাটা করে কিন্তু আমার দারুণ লাগে। একাধিক বার এনে খেয়েছি এবারে, রান্নার দিদিও একদিন আলু বড়ি টমেটম দিয়ে ঝোল, একদিন সর্ষেবাটা দিয়ে ঝাল করলেন। 

৬। ওদিকের বাড়িতে বাবা খাওয়ালেন সুন্দর মাঝারি সাইজের ভেটকি, আলু ফুলকপি দিয়ে। আরেকদিন বিশাল সাইজের ভেটকি শুধু ভাজাই খেয়ে ফেললাম। আমি ও বাবা সম্পূর্ণ মেছো, মোটামুটি যে কোনো মাছই আমরা যে কোনোভাবে খাওয়ার চেষ্টা করি। বাড়ির কাছেই বলে গড়িয়াহাট বাজারে একদিন গেলাম, আমাদের চেনা দোকানি ঝাড়া দশ বছর পর এক ঝলক দেখেই চিনে ফেলে বলল, “ইলিশ নিয়ে যান। ভাল আছে বাংলাদেশের।” সত্যিই ভাল ছিল। এবারে আর সুযোগ হয়নি ইলিশ খাওয়ার, ওই একবারই ঝোল ও ভাজা করে বেশ ভাল খেলাম। 

৭। হাসপাতালেই অনেকটা সময় কাটিয়েছি বলে তার গেটের বাইরে একদিন বেটার হাফ ডাব খেল। আমি ডাব ভালবাসি না, কেমন একটা সোঁদা গন্ধ লাগে জলে। এতে অবশ্য শাঁসও ছিল, সেটা খেলাম বরং একটুখানি। ডাবওয়ালা দাদা হেব্বি একটা ছড়া শোনালেন, ‘কাঁচা বাদাম’-খ্যাত দাদার মত। সেটা পরে আলাদা শেয়ার করব। 

৮। পাঁঠার মাংসের মত surreal জিনিস ব্রাসেলসে ভাল পাওয়া যায় না। এখানে ভেড়া খেয়ে খেয়ে হেজে যাই বলে পঃবঃ গিয়ে ভাল মাংসের সন্ধানে থাকি। তবে যা দাম দেখলাম তাতে পরের বার হয়ত কিডনি বেচতে হতে পারে। পাঁঠার মাংসের একটা টেক্সচার থাকে যা ভেড়াতে ঠিক মনমত হয় না। ব্রাসেলসের পাঁঠারা একটু সুখে বড় হয়, রেওয়াজি বাদে পাওয়া মুশকিল। আমরা আবার অত উচ্চাঙ্গ জিনিস বুঝি না, রেওয়াজ না করলেও আমাদের কাজ চলে যায়। কাজেই পঃবঃ গিয়ে খুঁজি কচি অথবা মেদহীন পাঁঠা। আমাদের মফঃ-এর দোকানিরা ক্রেতাদের অতিরিক্ত চর্বি দিয়ে খুশি করতে চান। না চাইলেও টুক করে দু’-চার টুকরো ঢুকিয়ে দেন প্যাকেটে। তাঁদের অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে কয়েকবার একটু কচি পাঁঠা পাওয়া গেছিল। বাবা একবার রান্না করে খাওয়ালেন কষা মাংস, একদম মাখা মাখা, মশলার আধিক্য নেই। ওদিকে রান্নার দিদি একবার পানসে ঝোল করে ফেলেছিলেন, পরের বার বেশ উপাদেয় কমের দিকে ঝোল করলেন। পাঁঠার অনুষঙ্গ হিসেবে আসে মেটে, যার জন্য আবার বেটার হাফের হৃদয়ে খুবই দোলা লাগে। সেই মেটের একটা কষা বিষ-ঝাল চচ্চড়িও হল একদিন। তবে এই ঘরোয়া ঝোল-কষা ছাড়াও তুলতুলে ভাল মাংস খেলাম বিরিয়ানিতে। 

৯। এবারে আসি সেই ব্যাপারটার কথায়, যার জন্য আমি মোটামুটি চাতক পাখির মত বসে থাকি সারা বছর – মটন বিরিয়ানি। ওসব চিকেন-ফিকেন ম্লেচ্ছ বিরিয়ানির কোনো কদর নেই আমার কাছে। তা যাইহোক, সেই ম্লেচ্ছ জিনিসই আনা হয়েছিল বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালের রাত্রে, ভারত জিতবে এই আশায়। বাকি ফলাফল তো আপনারা জানেনই। ব্যারাকপুরের বিখ্যাত ‘দাদা-বৌদি’র বিরিয়ানিরও একই ফলাফল হয়েছিল সেরাত্রে। এমন নয় যে অন্য সময়ে ওরা দারুণ বিরিয়ানি বানায় কিন্তু সেদিন খেলা দেখতে দেখতে অ-সেরা বানিয়েছে। গত ক’ বছরে যে ক’বার খেয়েছি, দাদা-বৌদির বিরিয়ানি ভাল লাগেনি। চাল ঝরঝরে হলেও তেল চপচপে এবং এরকম ঝাল বিরিয়ানি শেষ কবে খেয়েছি মনে নেই। সঙ্গের চিকেনটি একেবারে শুকনো ছিল। এরপর কলকাতায় বাড়িতে অর্ডার করলাম ‘আরসালান’-এর বিরিয়ানি। তার অবস্থাও তথৈবচ, সেটা গত বছর খেয়েও মনে হয়েছিল। মাংস সুসিদ্ধ হলেও তেল আর ঝালের আধিক্যে বিরিয়ানি না ঝোলভাত বোঝা মুশকিল। পর পর দু’বার হৃদয়ভঙ্গের প্রতিশোধ নিতে চলে গেলাম আমাদের প্রিয় ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান রেস্তোঁরা’তে, পার্ক সার্কাসে। মটন বিরিয়ানি – মটন চাঁপ, এই দুটোতেই রয়্যালের তুলনা হয় না, আমাদের মতে। সুন্দর ঝরঝরে হালকা মশলাদার মোতি বিরিয়ানি – আলু নেই বটে তবে তাতেও খেতে অসাধারণ। আর চাঁপ, আহা, খেতে কোনো চাপ হয়নি। তুলতুলে মাংসের টুকরোরা বিশাল এক কড়ায় কষতে কষতে যখন একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে, তখন তাদের একত্রে তত্ত্ব সাজানোর মত প্লেটে করে পরিবেশন করা হয়। আহা! রয়্যালের মূল দোকানে (নাখোদা মসজিদের কাছে) এক বয়স্ক কারিগর সারাদিন চাঁপের কড়াইয়ের সামনে বসে শিল্পকর্মে মগ্ন থাকতেন। এবারে গিয়ে শুনলাম তিনি অবসর নিয়েছেন কিন্তু তাঁর শিষ্যরা এখন চাঁপ বানান। 

১০। বিরিয়ানির গল্প এখানেই শেষ নয়। রয়্যালে খেয়ে যখন মনে হল মন ভরে গেছে, থাক আর বিড়ম্বনা বাড়িয়ে দরকার নেই, তখন বন্ধু দীপা বাড়িতে বানিয়ে খাওয়াল মটন বিরিয়ানি। সে এক দক্ষযজ্ঞ বটে – কত ঘন্টার পরিশ্রমে ঘেমেনেয়ে অবশেষে তৈরি হল সুগন্ধী বিরিয়ানি। স্বাদে-গন্ধে ও ভালবাসায় বানানো এই বাড়ির বিরিয়ানি যথেষ্ঠ উপাদেয় ছিল। 

১১। সবশেষে এক টুকরো আক্ষেপ নিয়ে বলি যে এবারে যা যা খাওয়া হয়ে ওঠেনি তার মধ্যে ছিল ফুচকা, এগরোল, কবিরাজি ও মোগলাই পরোটা। শেষের দুটো তেলের ভয়ে খাওয়ার খুব একটা সাহসও করিনি। প্রথম দুটো সময় সুযোগের অভাবে খাওয়া হয়নি। তার বদলে অবশ্য সিঙাড়া খেয়েছি বেশ কয়েকবার। সেখানেও দেখলাম আমাদের মফঃ-এর দোকান এখনও সেরা। দক্ষিণ কলকাতায় ভাল সিঙাড়া পাওয়া এখন দুষ্কর হয়েছে। তা বাদে দু-তিনদিন আলুর চপ খাওয়া হল – এটার জন্য আবার বেটার হাফ হাপিত্যেশ করে বসে থাকে, তাবে তার এবারে মন ভরেনি। চপের মান পড়তে পড়তে তলানিতে এসে ঠেকেছে। কী যে শিল্প হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না! 

১২। মধুরেণ সমাপয়েৎ যখন করতেই হয়, কয়েকটি মিষ্টির নাম না বললেই নয়। ডাক্তারের বাধানিষেধ ইত্যাদি পেরিয়ে এখন আর বাংলা মিষ্টি সারা বছর খাই না। বেটার হাফের আবার lactose intolerance, কাজেই আমাদের মিষ্টত্ব কমে গেছে একেবারেই। এই বছর গিয়ে দোকানে সদ্য তৈরি নরম ও কড়াপাক নলেন গুড়ের সন্দেশ দেখে লোভ সামলাতে না পেরে দু’খানা খেলাম। আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িতে আরো দু’-একখানা খাইনি তা নয়। শেষে বোধহয় ১৫-২০ বছর পরে একশো গ্রাম রাবড়ি খেলাম। এটা আজকালকার মিষ্টির দোকানে খুব একটা সুলভ নয়, আমাদের মফঃতে আরোই নয়। হঠাৎ দেখতে পেয়ে ভাবলাম ট্রাই করি, কিন্তু অতিরিক্ত মিষ্টি দুধের গোলা বাদে সেরকম কিছু পেলাম না। আরেকটি মিষ্টিও বোধহয় ১৫-২০ বছর পর খেলাম – লবঙ্গলতিকা। এর সঙ্গে আমার ছোটবেলার স্মৃতি আছে, কিন্তু এখন আর সেরকম ভাল লাগল না। 

লম্বা কৈফিয়ৎ হয়ে গেল বটে তবে এবারে যা যা খেয়েছি মোটামুটি মন দিয়ে খেয়েছি, তাই লিখতে গিয়ে বেশি ভাবতে হল না। আসছে বছর আবার হবে, নাকি?

 
Leave a comment

Posted by on December 28, 2023 in কলকাতা কচকচি

 

Leave a comment

 
The Ramblings of Don

Just my ramblings..... and sometimes my nostalgic memories!

Book Reviews by Satabdi

Candid opinions on books I read

photographias

photography and life

VR & G

Vigorous Radiant & Glowing

যযাতির ঝুলি | বাংলা ব্লগ | Jojatir Jhuli | Bangla Blog

বাংলা কবিতা, বাংলা গদ্য.. মুচমুচে, খাস্তা, অনবদ্য। ছুটির দুপুরে হোক না যোগ.. যযাতির গল্প, ছড়া, ব্লগ।।

feeble Lines

- By Adarsh

Natasha Ahmed

Author at Indireads

জীবনের আয়না

কিছু এলোমেলো ভাবনাচিন্তা

ব্লগম ব্লগম পায়রা

এটা-সেটা লেখা-দেখা...কখনো আনমনে কখনো সযতনে, টুকিটাকি আঁকিবুঁকি...সাদা-কালো সোজা বাঁকা

TRANSLATIONS: ARUNAVA SINHA

Bengali-to-English, English-to-Bengali literary translations

Cutting the Chai

India's original potpourri blog. Since 2005. By Soumyadip Choudhury

সাড়ে বত্রিশ ভাজা

একটি বাংলা ব্লগ

MySay.in | Political Cartoons and Social Views

Funny Cartoon Jokes on Latest News and Current Affairs.

Of Paneer, Pulao and Pune

Observations | Stories | Opinions

A Bookworm's Musing

Reading the world, one book at a time!

SpiceArt

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

Re.lexi.fication

Global structures. Local colour.

Abhishek's blog অভিষেকের ব্লগ

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

Calcutta Chromosome

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

Bookish Indulgences

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

monalisadesign

Monalisa's creations

of spices and pisces

food and the history behind it.