
ইন্টারনেটে বাড়ির বিজ্ঞাপন ধোঁকা দেওয়ার পর আমরা তাদের দ্বারস্থ হলাম যাদের হাতেই এখন এ শহরের চাবিকাঠি। তাদের পোষাকী নাম এজেন্ট অথবা ব্রোকার, ভালবেসে লালদাও বলতে পারেন। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে ইন্টারনেট পোর্টাল – সবাই তাদের খবর রাখে এবং দেয়। আমরাও ‘জয় মা’ বলে একেকটা এলাকা ধরে তাদের শরণাপন্ন হলাম। প্রতিটা জায়গায় ভিন্ন অভিজ্ঞতা হল, সেগুলো এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
রাজারহাট
মাড়োয়ারি বৌদির ফ্ল্যাট থেকে পালানোর পর তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে জাব হয়ে, আমিনিয়ার জঘন্য বিরিয়ানি খেয়ে এক চায়ের দোকানে লালদার খোঁজ করলাম। ভাতঘুম দিয়ে উঠে এক ভদ্রলোক কোনোমতে ফ্ল্যাট দেখাতে রাজি হলেন। যেগুলো আমাদের টার্গেট, সেগুলো আবার ওনার টার্গেটের বাইরে। সবারই এলাকা এবং বাজেট ভাগ করা থাকে, সেটা আমরা জানতাম কিন্তু বুঝতে পারিনি ভালো করে। এনার বাজেটটা আমাদের থেকে কম হওয়াতে বেশ ঘাবড়ে গিয়ে কিছু ভুলভাল ফ্ল্যাট দেখালেন। রাজারহাটের চিনার পার্ক মোড় থেকে বাঁদিকে গেলে জ্যাংড়া এবং হাতিয়াড়া পড়ে। সেখানে আছে লোকনাথ বাবার বিখ্যাত মন্দির। তার পাশের গলিগুলোর নাম লোকনাথ পার্ক। সেই অতীব সরু গলিতে আমাদের গাড়ি ঢুকবে না বলাতেও ভদ্রলোক জোর করে বাড়ি দেখাতে নিয়ে গেলেন। “পাশেই গ্যাসের দোকান, ওদের গাড়ি রোজ ঢুকছে আর আপনাদের গাড়ি ঢুকবে না?” অগত্যা।
বাড়ির বেসমেন্টে মুদির দোকান থেকে আরেক মাড়োয়ারি ভদ্রলোক উঁকি মারলেন। ততক্ষণে আমার ধারণা হয়েছে রাজারহাটে আমাদের দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় ছাড়া সব ফ্ল্যাটের মালিকই মাড়োয়ারি। তিনি আমাদের আপাদমস্তক মাপলেন। তারপর ঘুপচি এক সিঁড়ি দিয়ে আড়াইতলার ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন। দুটি অন্ধকার বদ্ধ ঘর, অপরিসর বাথরুম, জানলায় জং ধরা গ্রিল ইত্যাদি দেখে আমাদের আত্মারাম প্রায় খাঁচাছাড়া। ভদ্রলোক কিছুতেই মানবেন না যে ফ্ল্যাটটা আমাদের পক্ষে ছোট আর গাড়ির পার্কিং স্পেস নেই। অনেক তর্কের পর তিনি নিজেই বিধান দিলেন যে আমরা হাই ফাই টাইপ বলে তাঁর অত সুন্দর ফ্ল্যাটকে নস্যাৎ করে দিচ্ছি। কোনোমতে তাঁদের পাল্লা থেকে প্রাণ ও মান বাঁচিয়ে পালিয়েছিলাম। লালদা ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছিলেন কিন্তু দয়া করে আর পরে আমাদের খবর নেননি।
ফেরার পথে ট্যাক্সিতে বিমর্ষ হয়ে বসে আছি, ড্রাইভার আলাপ জুড়লেন। নিউটাউন-রাজারহাটে ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে চাই শুনে বললেন, “বৌদি সারাদিন বাড়িতে একা থাকবেন তো? রাত আটটার পর কিন্তু পুরো গল্প। বাস-অটো-ট্যাক্সি কিছু পাবেন না, কোনো অসুবিধা হলে বাড়ি থেকে বেরোতেই পারবেন না।” শোনার পর আজ অব্দি ওদিকপানে বেড়াতেও যাইনি।
মেট্রোপলিটান (চিংড়িহাটা)
ভাই-বন্ধু থেকে ইন্টারনেট, সবাই মেট্রোপলিটানের এত প্রশংসা করল যে আমরা দেখতে না গিয়ে থাকতে পারলাম না। সায়েন্স সিটি ছাড়িয়ে বর্তমান ভবন পেরিয়ে মেট্রোপলিটান বাস স্টপ। জায়গাটার নামের উৎপত্তি নাকি মেট্রোপলিটান হাউসিং সোসাইটি থেকে। নেট থেকে নম্বর নিয়ে ফোন করে সন্ধ্যাবেলা পৌঁছে গেলাম দুজনে। প্রথম লালদা বাইকে চড়ে বেশ ঘ্যাম নিয়ে এলেন, সঙ্গে আরেকজন বয়স্ক তস্য লালদা। দুজনে মিলে গোটাচারেক বেশ খাজা বাড়ি দেখালেন। কোথাও আমাদের পছন্দ হয় না তো কোথাও বাড়িওয়ালারা আমাদের পছন্দ করলেন না। কেউ বললেন পার্কিং স্পেস দিতে পারব না, গাড়ি বাইরে রাখুন (পড়ুনঃ “ভাড়াটের আবার চারচাকা কীসের!”) তো কেউ বললেন, “আমাদের সঙ্গে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি শেয়ার করতে হবে” (মানে আমাদের ঘরের ভেতর দিয়ে ওঁরা দোতলায় উঠবেন)।
দ্বিতীয় লালদা আবার আরেকটু উচ্চমানের। তিনি কিছু তিরিশ-চল্লিশ হাজারি ফ্ল্যাট দেখাতে চাইলেন, যা আমাদের বাজেটের দু-তিনগুণ। তিন-চারটে গলি মিলিয়ে যেটুকু এলাকা সেখানে আর কটা ফ্ল্যাট খালি থাকতে পারে! সব মিলিয়ে দেখেশুনে আমরা পাততাড়ি গোটালাম। ততক্ষণে বিকেলের ফুচকা-সিঙাড়া সব হজম হয়ে কোথায় তলিয়ে গেছে। একটিমাত্র পদের ফ্ল্যাট পাওয়া গেছিল কিন্তু এলাকাটা আমাদের পছন্দ না হওয়াতে নাকচ করতে হল। পরের দিন সকালে প্রথম লালদা ফোন করে বেধড়ক খিস্তি করলেন। ফ্ল্যাট দেখে ওনার সময় নষ্ট করে কেন বাতিল করেছি, সেই বাবদ। বিশ্বাস করুন, জীবনে এত হুব্বা আমি খুব কম হয়েছি। দোকানে ঢুকলেই যদি জামা কিনতে হয় তাহলে তো বাবার হোটেলও লাটে উঠবে! লালদারা এটা না বুঝলে আমরা সত্যিই অপারগ।
রুবি হসপিটালের আশেপাশে
নেট ঘেঁটে আরেকজন লালদার নম্বর পাওয়া গেল যিনি এই এলাকায় কাজ করেন। ততদিনে আমাদের সমস্ত আশা-উদ্যম প্রায় সাউথ ক্যানাল দিয়ে বয়ে গেছে। রাজারহাট থেকে রুবি অব্দি রফা টেনে আমরা এবং লালদারা সবাই ক্লান্ত। যাইহোক, আরও একবার বেরিয়ে পড়লাম মিশনে। প্রথমে যেখানে গেলাম, সেই জায়গাটার নাম মাদুরদহ, রুবি হসপিটালের একটা স্টপ পরে, গড়িয়ার দিকে। মাদুরদহের বাসিন্দারা রাগ করবেন না, নামটা একটু ইয়েমার্কা না? ভেতরে অবশ্য ঘ্যামা সব কমপ্লেক্স যেখানে ঢুকলে আপনার নিজেরই কমপ্লেক্স গজাবে যে কোথায় এলাম! বাইরে কিন্তু ধানক্ষেত, ধু-ধু প্রান্তর, বেশ অনেকদূর পর্যন্ত, সঙ্গে ঝিঁঝিঁ ফ্রি। বাড়িওয়ালি আবার বললেন, “আমরা কিন্তু পাশেই থাকি, প্রায়ই আসব আপনার সঙ্গে গল্প করতে।” আর কিছু না হলেও, এটাই একটা বড় শাসানি!
লালদা একটু অধৈর্য হলেও দেখলাম বেশ শান্ত শিক্ষিত মানুষ, লিস্ট থেকে মোটামুটি একটা করে টিক অফ করছেন। শেষে এলাম মাদুরদহের পারপেন্ডিকুলার রাস্তায়, রাসবিহারী কানেক্টর, নারকেলবাগান। রাজডাঙা খালের দুটো গলি আগের জনবসতির মধ্যে ফ্ল্যাট, চারিদিকে বাগান টাগানে ঘেরা, বেশ চমকানোর মত ব্যাপার। সব মিলিয়ে অন্যগুলোর থেকে ঢের ভালো, যদিও পার্কিং স্পেস নিয়ে এখানেও সমস্যা। কিন্তু আমাদের শিয়রে শমন বলে নেইমামার চেয়ে কানামামাতেই রাজি হয়ে গেলাম।
লালদা বিদায় নিলেন, নিজের পারিশ্রমিক নিয়ে, কোনোরকম তিক্ততা না রেখে।
(চলবে)…
অরিজিত
February 14, 2015 at 10:16 AM
ব্যাপক! লালদা নামটা খাসা লাগলো, আর তাদের কার্যকলাপও। 😀