RSS

পুণে পাঁচালী ২ – ভবা পাগলা

06 Aug
পুণে পাঁচালী ২ – ভবা পাগলা

ভবা পাগলার কথায় আসার আগে একটু ব্যাকগ্রাউন্ডটা দি। আমি যেখানে থাকি এখন, সেটা পুণের রাজারহাট বলা যায়। জায়গাটার নাম পিম্পলে সৌদাগর, আমরা আবার সেটাকে ছেলেখেলা করে পিম্পল গাঁও বলি। এখানে সব এলাকাতেই বড় রাস্তা ছাড়িয়ে একটু ভেতরে গেলেই সেটাকে লোকজন অমুক গাঁও তমুক গাঁও বলে। পিম্পল গাঁওতেও বড় বড় কিছু ফাঁকা জমি আর তার পাশাপাশি বিশাল বিশাল কমপ্লেক্স রয়েছে, এখানে যাকে সোসাইটিবলে। বৃহত্তর সমাজের মধ্যে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা টুকরো টুকরো সোসাইটি, যে যার মত আলাদা থাকার জন্যে। তো আমরাও এরকম একটি সোসাইটিতে থাকি, যেখানে ৪টি ব্লক আর তাকে ঘিরে বেশ খানিকটা উঠোন আর একফালি DSC08256বাগান আছে। সেই বাগানের এক কোণে আবার শ্বেতপাথরের ঢাকা বেদীতে শ্বেতপাথরেরই গণেশ রাখা। হ্যাঁ, গণেশ ছাড়া কী থাকবে? ভুলে যাবেন না, দেশের অধিকাংশ মানুষই তো মেজরিটি ধর্মভুক্ত। তা সে যাইহোক, ৪টি ব্লক মিলিয়ে (XX)=১২৮টি ফ্ল্যাট। মোটামুটি দুচারটে বাগানবাড়ির এলাকা মিলিয়ে যতটা জায়গা হয়, তাতে এতগুলো লোকের বসবাস করার জায়গা বানানো যায় সেটা আগে খেয়াল করিনি। আমি আগে কোনোদিন এরকম সোসাইটিওয়ালা ফ্ল্যাটে থাকিনি। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু মনে মনে ছবিটা আঁকলে একটা বেশ লম্বাটে ধরণের মৌচাকের মত মনে হয়, ওরকমই খুপরি খুপরি ঘর জুড়ে একটা পুরো সোসাইটি। মৌমাছিরা একে অপরকে চেনে কিনা জানিনা, তবে আমাদের ফ্লোরের চতুর্থ প্রতিবেশীকে আমি এখনো চোখে দেখিনি। তারা কখন আসে, কখন যায়, কী খায়, খোদায় জানে! দেশটা ধীরে ধীরে বিদেশ হয়ে যাচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। বিদেশে যে কমপ্লেক্সে ছিলাম সেখানেও একই ফ্লোরের প্রতিবেশীদের মুখ দেখিনি ছমাসেও। পাশের ফ্ল্যাটে ভারতীয়রা থাকত সেটা বুঝেছিলাম তাদের রান্নার গন্ধে, তার পাশের ফ্ল্যাটে লোকাল আইরিশ জনতা যাদের চেনা যেত প্রায়ই বিকেলে ডিনারের জন্যে স্টেক/রোস্ট রাঁধার গন্ধে, আর তাদের পাশে যারা থাকত তারা চাইনিজ বা কোরিয়ান – ওরকমই ধাঁচের দুটো বাচ্চার হুটোপাটি দেখা যেত আর ওদের বাথরুমের জানলায় এক পট ফুলগাছ রাখা ছিল।

আজকাল পিম্পল গাঁও আর আইরিশ ভিলেজ মোটামুটি কাছাকাছি হয়ে যাওয়াতে, এখানেও প্রতিবেশীদের চিনিনা ছমাস পরেও। তবে এরই মধ্যে আবির্ভাব হল ভবা পাগলার। আমার মামারবাড়ির পাড়ায় এক ভবা পাগলা ছিল, যে রাস্তায় প্রতিটা লোককে ডেকে তত্ত্বতালাশ নিত, ‘কেমন আছ? বউ কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে? মা কেমন আছে?’ ইত্যাদি। এখানে ভবা পাগলা আবার অন্যরকম। তার বয়স আপাতত সাত বা আট। সে বেচারা রোজ বিকেলে সাইকেলটি নিয়ে সোসাইটির কম্পাউন্ডে DSC08258চক্কর কাটে। তার মা বোধহয় বাইরে রাস্তায় বেরোতে দেয় না। এমনিতেও এখানে খেলার মাঠ নেই। দু তিন কিলোমিটার দূরে দূরে মিউনিসিপালিটির পার্ক বলে একটা ঢঙের জিনিস আছে, যেখানে বিল্ডাররা তাদের চুনবালিইঁট জড়ো করে রাখে আর কিছু অকম্মা ছোকরা বসে তাস পেটে। বাচ্চাদের খেলতে সেখানে কেউই পাঠায় না। আমাদের ভবা তাই উঠোনেই সাইকেল চালায়। তবে রোজ বিকেলে নিয়ম করে সে আধঘন্টা ধরে বিল্ডিংয়ের বাকি বাচ্চাদের খেলতে ডাকে। তার গলাটি বয়সের তুলনায় বেশ বাজখাঁই এবং খ্যানখ্যানে। দুদিন আগে সে আধঘন্টা ধরে ডেকেছিল আবিষ্কারকে। সেদিন রবিবার হওয়াতে আবিষ্কার বোধহয় খেলার বদলে মা বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছিল, তাই আর খেলতে নামেনি। গতকাল সে প্রথমে ডাকে প্রত্যুষকে, সাড়া না পাওয়াতে ডাকে আবিষ্কারকে, সেও সাড়া না দেওয়াতে পাশের বিল্ডিংয়ের কানহাকে খেলতে ডাকে। কানহার আবার অন্য বাচ্চাদের থেকে চাপ কিঞ্চিৎ বেশী। তার বাড়ি বৈষ্ণব হওয়াতে স্কুল থেকে ফিরে হাতে থলি নিয়ে তাকে বেশ কিছুক্ষণ জপ করতে হয়। তার মধ্যে ভবা তাকে খেলতে ডাকলে সে বেচারা চঞ্চল হয়ে বারান্দায় এসে জোরে জোরে জপ করতে থাকে আর তার মা পাশে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙায়। আধঘন্টা মত ডাকাডাকির পর ভবার আর এনার্জি থাকে না, সে ম্রিয়মাণ হয়ে সাইকেল চালাতে থাকে পাঁই পাঁই করে যতক্ষণ না আবিষ্কার খেলতে নামে।

ভবার অমায়িক গলার দৌলতে প্রত্যুষ থেকে আবিষ্কার থেকে কানহা, সকলকেই আমি চিনে গেছি। আবিষ্কার অবশ্য আমার ঠিক ওপরের ফ্ল্যাটেই থাকে। তার খেলাধুলোর চোটে টুকিটাকি খেলনা মাঝেমধ্যেই জানলা গলে আমাদের বারান্দায় এসে পড়ে। তার খানিকক্ষণ পরে সে এসে বেল বাজিয়ে দন্তবিকশিত হয়ে বলে, ‘আন্টি, ব্যালকনি সে বল দিজিয়ে না প্লিজ।তা বাপু ছোট বাচ্চারা আন্টি বললে মন্দ লাগে না, কিন্তু আবিষ্কারের আন্টি হওয়ার বয়স আমার হয়নি এখনো। এবার ঠিক করেছি ভবাকে ধরে একদিন নাম জিজ্ঞ্যেস করব। তার সঙ্গে কোনোদিন উঠোনে, সিঁড়িতে বা লিফটে দেখা হয়ে গেলেও তো আমি চিনতে পারব না যতক্ষণ না তার গলা শুনছি। বারান্দা থেকে সাইকেলরত ভবার মুখটা পরিষ্কার দেখা যায় না যে।

খ্যাপাকে মনে আছে তো, যে পরশপাথর খুঁজে খুঁজে ফিরত? পুণের ভবা পাগলা আপাতত শুধু খেলার সঙ্গী খুঁজে বেড়ায় রোজ। আজকাল সেটা প্রায় পরশপাথরেরই শামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

 
7 Comments

Posted by on August 6, 2013 in পুণে পাঁচালী

 

Tags: , , ,

7 responses to “পুণে পাঁচালী ২ – ভবা পাগলা

  1. শ্রীল শ্রীযুক্ত বাবু অভিষেক মুখোপাধ্যায়

    August 6, 2013 at 7:40 PM

    আরে, দারুণ লিখেছিস্‌!; আমার ঘ্যাম লেগেছে!

    তোর লেখার স্টাইলে একটা অ্যাডিক্টিভ ব্যাপার আছে। 😀

     
  2. Arijit

    August 6, 2013 at 7:48 PM

    bechara Bhawba 😦

    lekhata khasha, besh muchmuche ekta byapar acche 🙂

     
  3. Minko

    August 6, 2013 at 8:50 PM

    Jyoti-babu bangla likhte paarle eromi likhten! biswas kawr! kaata-kaata kawtha-chhobi, bhalo kawthay jetaake khondo-chitro bawla, jaay, sheygulo jurey ekta narrative-er (aakhyan jothartho bangla onubaad noy, tai ingriji-tai likhlam) aadol poshto phute uthechhe. jodio, bawlai baahulyo,ei narrative-er phnaake phnaake onyotawro narrative-er aabhash royechhe–gnao-er golper itihaash ebong shomaj-kirton-er dhuyaa– jaar kichhuta onumaan-o bawte.
    bhalo hoyechhe, Pri; mohaloya’r bhor-bhor laaglo eta porey!

     
  4. Chaitree Basak

    August 6, 2013 at 11:33 PM

    Ami Bhaba Pagla e Dikkhito – Hotat onar naam pore vablam – onar nanarokom kirtikolap er natun kichu peyechis hoeto 😛 … jaak pore bhalo laglo 😛

     
  5. pridreamcatcher

    August 7, 2013 at 2:16 PM

    চৈত্রী , ওরে বাবা, অত সিরিয়াস কোনো ব্যাপার নয়! তোর ভাল লেগেছে শুনে ব্যাপক লাগল।

     
  6. toa

    August 7, 2013 at 6:10 PM

    bah, good hoeche, aro chai 🙂

     
  7. স্মৃতিলেখা চক্রবর্ত্তী

    April 10, 2014 at 8:58 AM

    এই জন্যই তো দেশে কেউ খেলে না আজকাল; সব্বাই খেলা দ্যাখে। খেলা দেখা’র সঙ্গী প্রচুর!

     

Leave a reply to toa Cancel reply

 
The Ramblings of Don

Just my ramblings..... and sometimes my nostalgic memories!

Book Reviews by Satabdi

Candid opinions on books I read

photographias

photography and life

VR & G

Vigorous Radiant & Glowing

যযাতির ঝুলি | বাংলা ব্লগ | Jojatir Jhuli | Bangla Blog

বাংলা কবিতা, বাংলা গদ্য.. মুচমুচে, খাস্তা, অনবদ্য। ছুটির দুপুরে হোক না যোগ.. যযাতির গল্প, ছড়া, ব্লগ।।

feeble Lines

- By Adarsh

Natasha Ahmed

Author at Indireads

জীবনের আয়না

কিছু এলোমেলো ভাবনাচিন্তা

ব্লগম ব্লগম পায়রা

এটা-সেটা লেখা-দেখা...কখনো আনমনে কখনো সযতনে, টুকিটাকি আঁকিবুঁকি...সাদা-কালো সোজা বাঁকা

TRANSLATIONS: ARUNAVA SINHA

Bengali-to-English, English-to-Bengali literary translations

Cutting the Chai

India's original potpourri blog. Since 2005. By Soumyadip Choudhury

সাড়ে বত্রিশ ভাজা

একটি বাংলা ব্লগ

MySay.in | Political Cartoons and Social Views

Funny Cartoon Jokes on Latest News and Current Affairs.

Of Paneer, Pulao and Pune

Observations | Stories | Opinions

A Bookworm's Musing

Reading the world, one book at a time!

SpiceArt

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

Re.lexi.fication

Global structures. Local colour.

Abhishek's blog অভিষেকের ব্লগ

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

Calcutta Chromosome

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

Bookish Indulgences

"আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা..."

monalisadesign

Monalisa's creations

of spices and pisces

food and the history behind it.