প্রথম অঙ্ক প্রথম দৃশ্য
অ্যামেরিকা’র দক্ষিণ প্রান্তে একটি ক্যাম্পাস টাউন। প্রায় গ্রাম। দুর্গা পুজোর একমাস আগের এক সন্ধ্যা। একটি অ্যাপার্টমেন্টের লিভিং রুমে বেশ কয়েকটি ছেলে–মেয়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বসে–দাঁড়িয়ে আছে। সবাই মিলে কথা বলার ফলে কারুর কথাই বোঝা যাচ্ছে না।
অরিজিৎ(বেশ চেঁচিয়ে): এই তোরা সবাই একটু চুপ কর না, প্লিজ!
সবাই থমকে চুপ করে গেল।
অরিজিৎঃ উফ, মাথা ধরিয়ে দিল মাইরি! একজন একজন করে বল না, এত তাড়া কিসের?
নীলাদ্রিঃ আমরা সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছি, প্রথম পুজো বলে কথা!
দেবদীপঃ কিন্তু সত্যি, প্রথম পুজো হলেও, এরকম চিল্লামিল্লি করলে কোনো প্ল্যানই করা যাবে না। তোমরা এক এক করে বলো না।
রঞ্জিতাঃ অ্যাই নিলু–দা, চুপ কর তো। সবচেয়ে বেশি তুইই চ্যাঁচাচ্ছিলি। প্রেসিডেন্ট–দা, তুমি শুরু করো।
অরিজিৎঃ ইয়ার্কি মারিস না। (একটু থেমে) আমরা সবাই বিদেশে কলকাতার পুজো খুব মিস করি, তাই এখানে এবার প্রথমবার পুজো করার কথা ভাবছি।
রঞ্জিতা(আস্তে): ধ্যার, এটা সবাই জানে। তারপর বলো।
প্রতীকঃ ভাগ শালা, আমি জীবনে কলকাতার পুজো দেখিনি। দিল্লীর পুজোই মিস করি।
অরিজিৎঃ যেহেতু আমাদের বাজেট আর লোকবল দুটোই কম, খুব প্ল্যান করে আর সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।
নীলাদ্রিঃ প্রেসিডেন্ট–দা, বেকার ভাষণ দিও না, অত টাইম নেই। সামনের সপ্তাটা পুরো মিড–টার্মের বাঁশ, কাজের কথায় এসো।
অরিজিৎঃ তাহলে আমি বলছি কী কী লাগবে, দেবু একটা লিস্ট কর।
দেবদীপঃ বলো, আমি রেডি।
অরিজিৎঃ এক নম্বর হল, ঠাকুর। আমাদের পয়সা নেই, কাজেই বড় ঠাকুর আনার কোনো সিন নেই। এই চিত্রা একটা ছোট দুর্গা–মূর্তি নিয়ে এসেছে কলকাতা থেকে, ওটাকেই সাজিয়ে–গুছিয়ে পুজো করা যাবে।
ঊর্মিঃ এই, কিসের মূর্তি রে চিত্রা?
চিত্রাঃ আরে, কাঠের ওপর ব্রোঞ্জ রঙের পালিশ করা। দক্ষিনাপণ থেকে এনেছিলাম ঘর সাজাব বলে।
তন্ময়ঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, ওতেই হবে, ছাড় তো। পুজোর স্পিরিটটাই আসল।
অরিজিৎঃ দু’ নম্বর হচ্ছে, পুজোর ভেন্যু। আরো কিছু মেম্বার থাকলে নাহয় কমিউনিটি হল বুক করা যেত, এই ক’জনে ওখানে সবকিছু নিয়ে গিয়ে সামলাতে পারব না।
ঈশিতাঃ আমার একটা প্রস্তাব আছে। পুজোটা আমাদের বাড়িতে করা হোক। একতলাটা পুরোটাই লিভিং রুম তো, এই ক’জনে মোটামুটি জায়গা হয়ে যাবে।
তন্ময়ঃ আগে বল লোক ক’জন হবে? আমি তো যা দেখছি, গুনে–গেঁথে তিরিশ।
নীলাদ্রিঃ না গো, আমাদের সো–কল্ড অ্যান্টি–পার্টিকেও নেমন্তন্ন করব। দেখা যাক ক’জন আসে। চক্ষুলজ্জার খাতিরে কেউ কেউ অন্ততঃ আসবে মনে হয়।
চিত্রাঃ সত্যি, আমি এখানে এসে অবাক হয়ে গেলাম, যে এইটুকু একটা জায়গা, এই ক’জন মাত্র বাঙালি, তার মধ্যেও দুটো দল !
অরিজিৎঃ দুর, ওসব ছাড় এখন। লোক আমি পঁয়তিরিশ ধরে রেখেছি। (একটু থেমে) তাহলে ভেন্যুটা নিয়ে কারুর আপত্তি নেই তো?
প্রতীকঃ নাহ, ঈশিতাদের বাড়িতেই হোক। নেক্সট বল, কী কাজ।
অরিজিৎঃ নেক্সট হল সব জোগাড়–যন্তর। আমি সব লিস্ট করে দেব, কিন্তু বাজার–দোকানগুলো তোদের করতে হবে। পুজোর ঠিক আগের সপ্তাটায় বিশাল কাজের চাপ থাকবে আমার।
দেবদীপঃ সে জোগাড় হয়ে যাবে। কিন্তু লিস্ট চাই তো – পুজোর জিনিসের, খাবারের, ডেকোরেশনের…
প্রতীকঃ আব্বে, পুজোটা কে করবে সেটা আগে ঠিক কর।
ঈশিতাঃ এই তো নিলু আছে। অরিজিৎকে রান্নার দিকে থাকতে হবে, ও পারবে না।
নীলাদ্রিঃ যাহ শালা, আমি! অতক্ষণ উপোস করে পুজো, মারা যাব মাইরি।
ঊর্মিঃ তাহলে তুমি অন্য কাউকে সাজেস্ট করো।
রঞ্জিতাঃ দেখ, সুকল্যাণ স্যারকে বললে হয় না? উনি তো প্রতি বছর নিজের বাড়িতে সরস্বতী পুজো করেন, এটাও নামিয়ে দিতে পারবেন।
চিত্রাঃ কিন্তু অ্যান্টি–পার্টি এটা নিয়ে বাওয়াল দিলে?
তন্ময়ঃ আমাদের ক’জনকেই গিয়ে স্যারকে ম্যানেজ করতে হবে। প্রতীক, প্রেসিডেন্ট, কালই চল লাঞ্চের পরে।
নীলাদ্রিঃ সবই তো হল, কিন্তু তোরা খাওয়া–দাওয়ার কথাটা কেউ বলছিস না কেন রে?
রঞ্জিতাঃ উফ, এই এলেন পেটুকচাঁদ! তোকে কি আমরা না খাইয়ে রাখব নাকি রে পুজোতে?
ঈশিতাঃ নিরামিষ ভোগ হোক, খরচাও কম হবে, খাটনিও। তা ছাড়া বিজয়া সম্মিলনীতে তো অ্যান্টি–পার্টিরা বিরিয়ানি খাওয়াবে।
অরিজিৎঃ নিলু তোর স্পেশাল খিচুড়ি করবি। লাবড়া অ্যাজ ইউজুয়াল আমি। ঈশিতা চাটনি করবে, পায়েস আর বেগুনিটা তোরা কেউ দায়িত্ব নে।
প্রতীকঃ অ্যাই ইন্দ্র, তুই কিছু বলছিস না যে?
ইন্দ্রনীলঃ আমি তো নতুন, সব শুনছি। যা কাজ বলবে করে দেব, চাপ নেই।
প্রথম অঙ্ক দ্বিতীয় দৃশ্য
পাঁচ বছর পরে। স্কটল্যান্ডের উত্তর প্রান্তে একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউন। প্রায় গ্রাম। দুর্গা পুজোর একমাস আগের এক বিকেল। দু’জন তরুণ–তরুণী ফুটপাথ ধরে হাঁটছে। মেয়েটির হাতে ক্যামেরা। সে মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ছে ছবি তোলার জন্য। কিছুক্ষণ পরে ওরা একটি বাংলাদেশী দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল।
রঞ্জিতাঃ এ মা, এই দেখ, এই পোস্টারটা!
শান্তনুঃ কই, কি দেখব?
রঞ্জিতাঃ আরে, এই যে দোকানের উইন্ডোতে। দুর্গা পুজো হবে নাকি এখানে।
শান্তনুঃ অ্যাঁ, সে কি! এরকম তো কথা ছিল না।
রঞ্জিতাঃ দেখ, ইমেল আইডি দিয়েছে নাম রেজিস্টার করার জন্য। এখানে বাঙালী অ্যাসোসিয়েশনও আছে জানতাম না তো।
শান্তনুঃ দাঁড়া, দোকানদারকে জিজ্ঞ্যেস করি কেসটা কী।
পরের দিন দুপুর। অফিস ডেস্কে বসে রঞ্জিতা। দেখে মনে হয় খুব ব্যস্ত। ডেস্কে বসেই লাঞ্চ বক্স খুলে আনমনে খাওয়া শুরু করল। হঠাৎ কী মনে হওয়াতে Gmail-টা খুলল। কোনো এক শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য্য, যিনি পুজোর উদ্যোক্তা, ওর মেলের উত্তর দিয়েছেনঃ
“আপনার মেল পেয়ে খুব ভাল লাগল। আমরা এবারে প্রথমবার পুজো করছি এখানে। খুব বেশি বাঙালি তো নেই, তাও যে ক’জনকে কুড়িয়ে–বাড়িয়ে পাওয়া গেছে তাদের যোগাযোগ করেছি। আপনারও চেনা কেউ বাঙালি থাকলে তাদের জানাবেন। আমাদের পুজো সংক্রান্ত দুটো অ্যাটাচমেন্ট পাঠালাম। পরে আপনার সাথে ফোনে কথা বলে নেব।”
খেতে খেতে রঞ্জিতার মুখে আলতো হাসি ফুটে উঠল। সে স্বগোতক্তি করল, “আবার একটা প্রথম পুজো, আবার একটা ছোট শহর ! দেখা যাক।” দু’দিন পর। সন্ধ্যা আটটা। রান্নাঘরে কর্মরত রঞ্জিতা। শান্তুনু ইন্টারনেটে বোধহয় কোনো বিল পেমেন্ট করছে। ফোনটা বাজল।
শান্তনুঃ হ্যালো…
মহিলা কন্ঠস্বর (বাংলায়): হ্যালো, রঞ্জিতা আছে?
শান্তনু (একটু অবাক হয়ে): হ্যাঁ দিচ্ছি, একটু ধরুন।
রঞ্জিতাঃ হ্যালো…
মহিলাঃ হ্যালো রঞ্জিতা, আমি শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য্য বলছি।
রঞ্জিতাঃ শর্মিষ্ঠা…মানে কে বলুন তো…ঠিক…
শর্মিষ্ঠাঃ সেই যে পুজো নিয়ে মেল–এ কথা হল।
রঞ্জিতাঃ ওহ, বুঝেছি। বলুন।
শর্মিষ্ঠাঃ আপনারা কি এখানে নতুন এসেছেন না পুরনো বাসিন্দা?
রঞ্জিতাঃ না না, আমরা সবে দু’মাস হল এসেছি, চাকরি–সূত্রে।
শর্মিষ্ঠাঃ ওহ, আপনি কি একা, না ফ্যামিলি নিয়ে?
রঞ্জিতাঃ আমি আর আমার হাজব্যান্ড থাকি, দু’জনেই চাকরি করি।
শর্মিষ্ঠাঃ ওহ আচ্ছা, আমরা এখানে বছর দুই হল আছি।
রঞ্জিতাঃ পুজোয় ক’জন লোক হবে বলে মনে হয় এখানে?
শর্মিষ্ঠাঃ এখনো অব্দি যা রেসপন্স পেয়েছি, তাতে চল্লিশ হবে মনে হচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে।
রঞ্জিতাঃ তাহলে তো প্রথম পুজো হিসেবে মন্দ না।
শর্মিষ্ঠাঃ হ্যাঁ, কিন্তু এখানে সবাই তো ব্যস্ত যে যার চাকরি নিয়ে, সময় বের করে যেটুকু করা যায়। আমি মোটামুটি লিস্ট করেছি একটা, কে কোন কাজে থাকবে পুজোর দিনগুলোতে। আপনি যেটা করতে পারবেন বলবেন। হল বুকিংও হয়ে গেছে তিন দিনের জন্য।
রঞ্জিতাঃ হ্যাঁ জানিয়ে দেব নিশ্চয়ই। আমরা অবশ্য প্ল্যান করছিলাম অন্য কোথাও বড় পুজোতে যাওয়ার। কিন্তু এখানেই হচ্ছে যখন…
শর্মিষ্ঠাঃ না না, প্লিজ এখানেই থাকুন। বড় পুজো তো অনেক দেখতে পাবেন, আমরা প্রথমবার করছি, সবাইকেই দরকার।
রঞ্জিতাঃ হ্যাঁ এখানেই থাকব ঠিক করলাম। আচ্ছা, আপনারা একটা মীটিং করুন না সবাইকে নিয়ে, পুজোর আগে। আমরা তো কাউকেই চিনি না, আলাপও হয়ে যেত।
শর্মিষ্ঠাঃ এটা খুব ভাল আইডিয়া দিয়েছেন। তাহলে মহালয়ার পরের দিনই করা যায়, ওটা তো শুক্রবার পড়েছে, সবাই অফিসের পর আসতে পারবে সন্ধ্যেবেলা। আমি সব অ্যা্রেঞ্জ করে আপনাদের মেল–এ জানিয়ে দেব।
রঞ্জিতাঃ হ্যাঁ অবশ্যই, আমরা যাব।
শর্মিষ্ঠাঃ ঠিক আছে, রাখলাম তাহলে।
ফোনটা রেখে রঞ্জিতা শান্তনুর দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণভাবে হাসল।
রঞ্জিতাঃ শুনলি তো সব?
শান্তনুঃ উফ, এই প্রথম পুজো মানেই কয়েকটা বাঙালি একজায়গায় হয়ে মারামারি করবে।
রঞ্জিতাঃ আহা, দেখিই না কেমন হয়। আমাদের ক্যাম্পাসের মত সেইরকম হবে না নিশ্চয়ই।
শান্তনুঃ দুর, এখানে সব অচেনা জনতা দেখছিস তো। তোদের ওখানে তাও বন্ধু–বান্ধব ছিল অনেক। ভাল্লাগে না শালা।
রঞ্জিতাঃ আরে দেখি না গিয়ে একটা বছর, বড়লোক NRI-দের পুজো কেমন হয়।
দ্বিতীয় অঙ্ক প্রথম দৃশ্য
অ্যামেরিকা’র সেই ক্যাম্পাস টাউন। পুজোর তিন দিন আগের বিকেল। ঈশিতা, রঞ্জিতা আর চিত্রা বাসে করে যাচ্ছে কোথাও।
চিত্রাঃ আচ্ছা, ওই দূরের ইন্ডিয়ান স্টোরটায় পুজোর সব জিনিস পাওয়া যাবে, ঈশিতা–দি?
ঈশিতাঃ আমি ফোন করেছিলাম ওদের, বেশ কিছু জিনিস পাওয়া যাবে। বাকি ধর, যেমন, গঙ্গাজল। ওটা অরিজিৎের কাছে আছে। বেশ কিছুটা নিয়ে এসেছিল দেশ থেকে, নিষ্ঠাবান বামুন তো!
চিত্রাঃ আর কোষাকুষি, হ্যান ত্যান? রঞ্জিতাঃ ওগুলো সব সুকল্যাণ স্যারের কাছে আছে।
ঈশিতাঃ উফ, স্যারকে যে রাজি করানো গেছে এই অনেক। নাহলে আবার পুরুত খোঁজা নিয়ে ঝ্যাম হত।
রঞ্জিতাঃ আজকে আমরা ফেরার পথে ফলের বাজারটাও করে রাখব, প্রসাদের জন্য লাগবে তো।
চিত্রাঃ এ মা, তাহলে আরো কাউকে সঙ্গে আনলে হত, এত বোঝা বইতে হবে…
ঈশিতাঃ তুই কাকে সঙ্গে আনার কথা বলছিস সেটা আমরা জানি, কিন্তু সে তো এখন গানের রিহার্সাল দিচ্ছে, সোনা।
চিত্রাঃ ধ্যাত, বাজে বোকো না।
রঞ্জিতাঃ ওহ, তোরা এই ন্যাকামি থামা, আমাদের স্টপ এসে গেল।
ঘণ্টা দুই পরে। তিন জনে হাতে মালপত্র নিয়ে বাস থেকে নামল। মিনিট দুই হেঁটে একটি দোতলা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল। এই সেই লিভিং রুম যেখানে পুজো হবে। এ বাড়িতে ঈশিতা, রঞ্জিতা আর নীলাদ্রি থাকে। এই মুহূর্তে সেখানে ইন্দ্রনীল গান ধরছে, প্রতীক গীটার বাজাচ্ছে, নীলাদ্রি, দেবদীপ আর তন্ময় বসে আছে। মেয়ে তিনটি ঢুকতে ওরা গান থামিয়ে তাকাল।
রঞ্জিতাঃ উফ, কতক্ষণ লাগল মাইরি! (একটু থেমে) এই দেখো সবাই, বাজার করে এনেছি সব।
তন্ময়ঃ ভাল করেছিস। আমরা কালকে যাব বাকিগুলো করতে। অরিজিৎ একটু ফ্রি হোক।
চিত্রাঃ তোমাদের রিহার্সাল কদ্দুর? তন্ময়–দা’র আবৃত্তি?
ইন্দ্রনীল একবার চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে।
তন্ময়ঃ চলছে।
প্রতীকঃ ঈশিতা কী যেন সারপ্রাইজ দিবি বলছিলি সবাইকে?
ঈশিতাঃ ওহ হ্যাঁ, সারপ্রাইজ নিজেই চলে আসার আগে ইন্ট্রোটা দিয়ে দিই। কালকে অফিস বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুনলাম কেউ বাংলায় গুনগুন করছে। গিয়ে দেখি একটা নতুন মেয়ে, দেরিতে জয়েন করেছে এই সেমিস্টারে, ভিসার প্রবলেম ছিল বলল। আমি তো জানিসই, নতুন বাঙালী দেখেই খপ করে গিয়ে ধরলাম। তো সে বলল ভাল নাচে নাকি। আমি সোজা ওকে পুজোর প্রোগ্রামে ঢুকিয়ে দিলাম। আজকে আসবে, তোরা একটু আলোচনা করে নিস কখন কী করবে।
নীলাদ্রিঃ বাবা, একটা নতুন মেয়েকে দশ মিনিট দেখেই তুই এত খবর বার করে ফেললি?
ঈশিতাঃ আরে ক্যালি লাগে, বস। আমি ওকে একটু খোঁচাতেই অর্কুট খুলে ওর নাচের ভিডিও দেখিয়ে দিল। বেশ ভাল নাচে রে। তোরা একটু কো–অর্ডিনেট করে নিস ওর সাথে। মেয়েটার নাম হল রিমঝিম। একটু পরেই আসবে এখানে।
দেবদীপঃ বেশ, তাহলে প্রোগ্রামের লিস্ট হচ্ছে – প্রথমে ঈশিতা–দি আর চিত্রার আগমনী গান, তারপর তন্ময়–দা’র আবৃত্তি, মাঝে রিমঝিমের নাচ হয়ে যাক, আর লাস্টে ইন্দ্র’র গান। আর কেউ লাস্ট মিনিটে কিছু করতে চাইলে করবে।
তন্ময়ঃ উফ দেবু, তোর এই সবকিছুতে লিস্ট দেওয়ার স্বভাবটা আর কিছুতেই গেল না!
দেবদীপঃ লিস্ট না দিলে সব কাজ নামবে? নীলাদ্রিঃ ভালোয় ভালোয় পুজোটা নেমে যাক, দুগগা দুগগা!
দ্বিতীয় অঙ্ক দ্বিতীয় দৃশ্য
পাঁচ বছর পরে। স্কটল্যান্ডের সেই টাউন। একটি কমিউনিটি হলে বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক–ভদ্রমহিলা চেয়ারে সারি দিয়ে বসে আছেন। সবাই মোটামুটি চুপচাপ। কেউ কেউ একে অপরের দিকে, কেউ জানলা দিয়ে বাইরে, কেউ বা দেওয়ালে লাগানো রঙচঙে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন। দু–চারটি কিশোর–কিশোরী নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে গল্প করছে। সাকুল্যে একটি বাচ্চা চুষিকাঠি মুখে প্র্যামে শুয়ে আছে।
এক ভদ্রমহিলা (উঠে দাঁড়িয়ে): অনেকেই তো এসে গেছেন, এবার তাহলে আমরা আলোচনা শুরু করি?
দু’তিনজন সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। ভদ্রমহিলার গলার কাছে শাড়িতে একটি কাগজে নাম লেখা, ‘শর্মিষ্ঠা’।
শর্মিষ্ঠাঃ কথায় বলে, বাঙালী যেখানে যায় তেরো পার্বণ সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আমরা অনেকেই এখানে অনেক বছর ধরে আছি, পুজোতে বড় শহরে যাই প্রতি বছর, কারুর ভাগ্যে থাকলে সে দেশে যায় পুজোর সময়। কিন্তু এত বছরেও এখানে কেউ দুর্গাপুজো শুরু করেনি। হয়তো ছোট জায়গা, কম বাঙালী বলে। কিন্তু প্রবাসে দৈবের বশে যখন আমরা এসেই পড়েছি, একটু উদ্যোগ নিয়ে পুজোটা শুরু করতে ক্ষতি কি?
রঞ্জিতা মোবাইলের নোটপ্যাডে কিছু টাইপ করে শান্তনুকে দেখালঃ “সব জায়গাতেই একটা করে অরিজিৎ–দা থাকে নাকি রে? ফালতু ভাষণ ঝাড়ছে।”
শর্মিষ্ঠাঃ আলোচনা শুরু করার আগে আমি চাইব সবাই এক এক করে নিজেদের নামগুলো লিখে একটু ট্যাগ করে নিন প্লিজ। এখানে তো অনেকেই নতুন এসেছেন, বাকিদের সাথে আলাপ হয়ে যাবে।
সবাই এক এক করে কাগজে নাম লিখে গায়ে সেঁটে নিল।
এক ভদ্রলোক (বিনা নেম ট্যাগের): তাহলে শর্মিষ্ঠা, এইবার কাজের লিস্ট ধরে ডিসকাশন শুরু করো।
শর্মিষ্ঠাঃ হ্যাঁ, সবাই একটু অ্যাটেনশন দিন। আমি লিস্ট ধরে এক এক জনের নাম বলব যারা সেই কাজগুলো করতে রাজি হয়েছেন।
রঞ্জিতা আবার নোটপ্যাডে লিখলঃ “এবারে আমি ঘুমিয়ে পড়ব রে।” লিস্টে রঞ্জিতার নামও যোগ হল, প্রসাদের ফল কাটা ও বিতরণের কাজে।
এক ভদ্রলোক (যার বুকে নাম লেখা, ‘অভিজিৎ’): আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে আপনাদের কাছে। পুজো করার দায়িত্বে আমি আর শুভ–দা আছি, আপনাদের কারুর সংস্কৃত মন্ত্রগুলোর সঠিক উচ্চারণ জানা থাকলে প্লিজ হেল্প করবেন।
এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক (যার সোয়েটারের হাতায় নাম লেখা, ‘সুবীর’): আমি জানি, বলে দেব’খন।
শর্মিষ্ঠাঃ যেহেতু আমাদের বাজেটও কম, পুজোর ফল–মিষ্টিগুলোর জন্যে আমাদের স্পন্সর চাই। আপনারা সবাই এগিয়ে আসলে খুব ভাল হয়।
শান্তুনু এবার নোটপ্যাডে লিখলঃ “এরকম বৌদিরা ডাকলে আমি সবসময় এগিয়ে যেতে রাজি।” রঞ্জিতা এটা পড়ে ওর দিকে হাসিমুখে চোখ পাকাল। এক বৃদ্ধ পেছনের সারিতে বসে ঝিমোচ্ছিলেন, হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসলেন। তাঁর বুক পকেট থেকে নেম ট্যাগটা খুলে আসাতে নামটা বোঝা যাচ্ছে না।
বৃদ্ধঃ অষ্টমীর পুজোর ফল আর মিষ্টি আমি স্পন্সর করলাম।
শর্মিষ্ঠাঃ ডক্টর ঘোষের জন্য সবাই হাততালি দিন!
রঞ্জিতার পাশে বসা ভদ্রমহিলা, প্রচন্ড চড়া মেক–আপ করা এবং পোষাকে পুরোদস্তুর বিদেশিনী, নীচু গলায় কিছু বলতে চাইছেন অনেকক্ষণ ধরে। দু’তিনবার চেষ্টার পর একটু গলা তুলে নিজের বক্তব্য রাখলেন।
ভদ্রমহিলাঃ আমি তাহলে নবমীর দিনের পায়েসটা করে আনতে পারি?
শর্মিষ্ঠাঃ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পারো। তোমার নামটা কী, ভাই?
ভদ্রমহিলাঃ মধুশ্রী।
দুটি ছেলে, যাদের বুকে নাম লেখা, ‘অমিত’ ও ‘সঞ্জয়’, পেছনের সারি থেকে হাত তুলল।
অমিতঃ শর্মিষ্ঠা–দি, আমরা তো স্টুডেন্ট, বেশি কিছু দিতে পারব না। মিষ্টি কোথায় পাওয়া যায় বলে দিন, দু’জনে শেয়ার করে কিনে আনব।
এক ভদ্রলোক(যার জামার হাতায় নাম লেখা, ‘শুভায়ু’): বেশ, তাহলে স্পনসরের সমস্যা মিটে গেল। কালচারাল প্রোগ্রামের দায়িত্বে আছে দেবযানী(এক ভদ্রমহিলার দিকে হাত দেখিয়ে, যিনি প্র্যামে শোয়া বাচ্চাটিকে দোলা দিচ্ছিলেন), যে যে পার্টিসিপেট করতে চাও ওর সাথে কন্ট্যাক্ট করো।
শর্মিষ্ঠাঃ বাহ, সবাইকে অনেক ধন্যবাদ, আজকে আসার জন্যে। এই তো দেখুন কী সুন্দর সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। এবার পুজোটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেলেই হয়। জয় মা দুর্গা!
* এই নাটকটি গুরুচন্ডা৯-র পুজো ইস্পেশাল, ২০১১ তে প্রকাশিত *
Sulagna
February 22, 2013 at 1:36 AM
Tor lekha natok ta age kokhono porini. Khub bhalo likhechhis. Aro lekh…shubhechha roilo.
স্মৃতিলেখা চক্রবর্ত্তী
April 10, 2014 at 9:26 AM
বাঙ্গালী একাই একশো হতে পারে, কিন্তু একশো বাঙ্গালী কখনো এক হতে পারে না। এই তো আমাদের ছোট্ট জায়গা কোপরখৈরানে; তাতেই ২-২টো বাঙ্গালী সমিতি!
PRB
April 10, 2014 at 9:29 AM
কোপরখৈরানের নাম শুনেছি। আপনার মন্তব্যগুলো পেয়ে খুব ভাল লাগছে। পড়তে থাকবেন, পাঠকদের জন্যেই লেখা। 🙂
ভাল থাকবেন।